ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নব্য জেএমবির জঙ্গীরা ভারতে পালানোর চেষ্টা করছে

জঙ্গী তামিমের সহযোগী কামরান গ্রেফতার, ৬ দিনের রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জঙ্গী তামিমের সহযোগী কামরান গ্রেফতার, ৬ দিনের রিমান্ডে

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অভিযানকালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হওয়া নব্য জেএমবির জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যানের দেয়া জবানবন্দীতে এক ডজনের বেশি জঙ্গীর নাম পেয়েছে, যাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করছে তদন্তকারীরা। রিগ্যানের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী বুধবার রাত আটটার দিকে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকা থেকে গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারী তামিম আহমেদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সালাউদ্দিন কামরানকে গ্রেফতার করে ৬ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। জঙ্গী বিরোধী অভিযানের মুখে নব্য জেএমবির জঙ্গী যারা বেহশত লাভের আশায় শহীদ হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিল সেই জঙ্গীরাই এখন সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করছে। নব্য জেএমবির জঙ্গীরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সেজন্য সীমান্ত এলাকায় সতর্ক নজরদারি শুরু করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি, কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ ও শোলাকিয়ায় হামলা ও জঙ্গী আস্তানায় নিহত ২১ জঙ্গীর ভিসেরা রিপোর্টের রাসায়নিক পরীক্ষা করে ক্যাপটাগন, ইয়াবা বা অন্য কোন মাদক গ্রহণের তথ্য পায়নি সিআইডি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির প্রধান ও গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরীর ঘনিষ্ট সহযোগী সালাউদ্দিন কামরান ধরা পড়েছে। তাকে গ্রেফতারের পর আদালতে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এর আগে কল্যাণপুরে পুলিশ অভিযানের সময়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যেসব জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পুলিশের এই অভিযানেই ধরা পড়ে সালাউদ্দিন কামরান। বুধবার রাত আটটার দিকে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেছেন, সালাউদ্দিন কামরান নিষিদ্ধ ঘোষিত নব্য জেএমবির সদস্য হিসেবে সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রচার চালাত। তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সালাউদ্দিন। তিনি কল্যাণপুরে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নিহত আবু হাকিম নাইমেরও ঘনিষ্ঠজন। গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়ায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নিহত হন গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সালাউদ্দিন কামরান। এ ছাড়াও সালাউদ্দিন কামরান গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত আবু হাকিম নাইমের সহযোগী। কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার রাকিবুল হাসান রিগ্যান জবানবন্দীতে বলেছে, তার সঙ্গে সালাউদ্দিন কামরান একত্রে ছিল এবং একত্রে জঙ্গী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। কল্যাণপুরে জঙ্গী অভিযানের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সালাউদ্দিন কামরানকে। ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আজ তাকে আদালতে পাঠানোর পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সালাউদ্দিন কামরানকে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এই কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে সালাউদ্দিন কামরান বলেছেন, জঙ্গী আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন গত মে মাসে। নব্য জেএমবির কর্মকা-কে গতিশীল ও উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচার কার্যক্রম চালাতেন তিনি। কল্যাণপুর অভিযানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত রাকিবুল হাসান রিগ্যানের কাছে মিরপুরের পাইকপাড়ায় এক জঙ্গী আস্তানায় তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ৬ দিনের রিমান্ডে সালাউদ্দিন কামরান ॥ বুধবার রাতে টঙ্গী এলাকা থেকে নব্য জেএমবির সদস্য সালাউদ্দিন কামরানকে গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬ দিনের রিমান্ডে এনেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ জঙ্গী সালাউদ্দিন কামরানকে কল্যাণপুরের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে আনা হয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম ১০ দিনের হেফাজতের আবেদন করলে শুনানি শেষে ৬ দিন মঞ্জুর করেন বিচারক মাহমুদুল হাসান। সালাউদ্দিনের পক্ষে কোন আইনজীবী শুনানি করেননি বলে আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। রিগ্যান ও সালাউদ্দিনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ॥ সালাউদ্দিন কামরানকে গ্রেফতারের পর আদালতে হাজির করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্মকর্তারা। এর আগে রাকিবুল হাসান রিগ্যানকেও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছেন তারা। দু’জনকেই কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশী অভিযানের ঘটনায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে জিজ্ঞাসাবাদে নব্য জেএমবির যেসব জঙ্গী পলাতক তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে দেশের উত্তরাঞ্চল, রাজধানী ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় যারা ছিল বা আছে তাদের নামের তালিকার (সাংগঠিক নাম) তথ্য দিয়েছে সে। রাকিবুল হাসান রিগ্যানের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই বুধবার রাতে টঙ্গী এলাকা থেকে সালাউদ্দিন কামরানকে গ্রেফতার করা হয়। এখন আবার সালাউদ্দিন কামরানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অন্য যারা পলাতক তাদেরও তথ্য নেয়া হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে রিগ্যান ও সালাউদ্দিন দু’জনই জানিয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে তারা ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছে পলাতক নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। এরই মধ্যে গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন দুই জঙ্গী রিপন ও খালিদ ভারতে পালিয়ে গেছে। ভারতে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশের ভেতরে পলাতক জঙ্গীরা সীমান্ত পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিমান্ডে এনে রিগ্যান ও সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। দেশের উত্তরাঞ্চল ও রাজধানী ঢাকায় অবস্থানকারী পলাতক অন্তত এক ডজনের বেশি জঙ্গীর নামের তালিকা (সাংগঠনিক নাম) পেয়েছে তদন্তকারীরা। যেসব জঙ্গীর নামের তালিকা পাওয়া গেছে তারা উত্তরাঞ্চলে আত্মগোপন করেছে এবং সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে আছে। জিজ্ঞাসাবাদে রিগ্যান জানিয়েছে, নিউ জেএমবির বড়ভাই রবিনের গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জঙ্গী প্রশিক্ষণ আস্তানায় যাতায়াত ছিল। শোলাকিয়ায় হামলার পর নিহত জঙ্গী শফিউলের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল রবিনের। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তার। কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় যাতায়াত ছিল মারজানের। জঙ্গী রিগ্যান ও রবিনের বড়ভাই সাকিব মাস্টার, দেশের উত্তরাঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকা জঙ্গী মাসুদ, রাজীব, শিহাব, আজাদুল কবিরাজ নাম পাওয়া যাওয়ার পর তাদের খোঁজা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী রিগ্যান, সালাউদ্দিনসহ কয়েক জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর যেসব জঙ্গীর নামের তালিকা পাওয়া গেছে তারা যাতে পালিয় যেতে না পরে সেজন্য সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। সতর্ক করে দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। নিহত ২১ জঙ্গীর রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি, শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা ও কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জে নিহত ২১ জঙ্গীর রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট তৈরি করেছে সিআইডি। নিহত ২১ জঙ্গী ছিল ঠা-া মাথার খুনি। সিআইডির রাসায়নিক পরীক্ষাগারে তাদের ভিসেরা পরীক্ষায় ক্যাপটাগন, ইয়াবা বা অন্য কোন ধরনের মাদক গ্রহণের প্রমাণ মেলেনি। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিআইডি রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান ড. দিলীপ কুমার ঘোষ। তিনি জানিয়েছেন, রাজধানীর গুলশান, কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ ও শোলাকিয়ার ঘটনায় নিহত মোট ২১ জঙ্গীর ভিসেরা পরীক্ষার জন্য নমুনা (স্টমাক, লিভার, কিডনি ও রক্ত) পাঠানো হয়। পরীক্ষায় তাদের কারও দেহে ক্যাপটাগন, ইয়াবা কিংবা অন্য কোন ধরনের মাদক গ্রহণের প্রমাণ মেলেনি। গুলশানে দেশী-বিদেশী নাগরিককে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার পরবর্তী দৃশ্যপট দেখে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন, আইএসের মতো দেশী জঙ্গীরাও হয়ত ক্যাপটাগন কিংবা ইয়াবাজাতীয় উদ্দীপক মাদক গ্রহণ করে মাদকাসক্ত অবস্থায় এসব হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এ জন্য নিহত জঙ্গীদের ময়নাতদন্ত শেষে তাদের ভিসেরা পরীক্ষার জন্য মহাখালীর সিআইডি রাসায়নিক পরীক্ষাগারে নমুনা পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে গুলশানের ৭, কল্যাণপুরের ৯, নারায়ণগঞ্জের ৩ জনের ভিসেরা ও রক্তের নমুনা সিআইডি রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে শোলাকিয়ার ২ জঙ্গীর নমুনা পাঠানো হয়। শুধু গুলশানেই নয় কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ কিংবা শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গীদের দেহেও মাদক গ্রহণের কোন প্রমাণ মেলেনি। এছাড়া বিষজাতীয় কোন কিছু গ্রহণের প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
×