ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ এখন ঘুমোতে যাব।/বহুদিন/ঘুমোতে পারি নি।/ঘুমোতে পারি নি আমি/বহুদিন/রাতের বালিশে।/এখন ঘুমোতে যাব...। ঘুমোতে গেলেন সৈয়দ শামসুল হক। এই ঘুম ঘুম নয়, চিরনিদ্রা। মঙ্গলবার ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশের অগ্রগণ্য কবি। বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সব্যসাচী লেখককে শেষ বিদায় জানান রাজধানী শহরের মানুষ। বহুকাল আগে ফেলে আসা গ্রাম যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বিকেলে সব্যসাচী যান পিতৃনিবাস কুড়িগ্রামে। সেখানেই লেখা হয় তাঁর এপিটাফ! ক্যান্সার আক্রান্ত সৈয়দ হকের মৃত্যু যে ঘনিয়ে আসছে সে কথা জানাই ছিল। এর পরও শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না পাঠক। এত বড় ক্ষতি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। শিল্প সাহিত্য অঙ্গনের মানুষ সৃষ্টির মাঝে খুঁজছেন সৈয়দ হককে। বিশেষ করে বাংলা কাব্যনাট্যের আলোচনায় বার বার আসছে অনন্য এই স্রষ্টার নাম। তাঁর লেখা প্রথম কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।’ মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে সেই ১৯৭৫ সালে লেখা। ঢাকার মঞ্চে আসার পর পরই বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। আর আজ তো ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ব্যতিরেকে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। শিল্পকলা একাডেমি ও বেইলী রোডের নাটকপাড়ার সব আলোচনায় অনিবার্য হয়ে আসছে মঞ্চের অত্যুজ্জ্বল দিনগুলোর স্মৃতি। সত্তরের দশকে নাটকটি প্রথম মঞ্চে আনে ঢাকার বিখ্যাত দল থিয়েটার। সেই স্মৃতির কথা জানতে বৃহস্পতিবার বিকেলে কথা হচ্ছিল দলপ্রধান রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৭৬ সালে সৈয়দ হকের স্ক্রিপ্টটা আমাদের হাতে আসে। একসময় ধারণা ছিল, কাব্যনাট্য মানে কেবলই কবিতা। নাটকীয়তা কম। কিন্তু প্রযোজনাটি মঞ্চে আনতে গিয়ে পুরনো ধারণা আমূল বদলে যায়। তিন মাস রিহার্সাল শেষে প্রথম মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের উপর এখন পর্যন্ত যত নাটক হয়েছে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশিষ্ট এই নাট্যজন জোর দিয়েই বলেন, কাব্যনাট্য সুলিখিত হলে, প্রযোজনা ভাল করা গেলে দর্শকের মনে সেটি রেখাপাত করবেই। সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় কাব্যনাট্য ‘নূরলদীনের সারাজীবন।’ এখানে প্রতিবাদী চেতনা। বিদ্রোহ বিপ্লবের আশ্চর্য সুন্দর ডাক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের অজস্র ছোট-বড় ইতিহাস সারা বাংলায় ছড়িয়ে আছে। সেগুলোর একটি বেছে নিয়ে অসামান্য উপস্থাপনা দেন সৈয়দ হক। রংপুর অঞ্চলের ভূমিপুত্র নূরলদীনকে এমন এক গণনায়কের চরিত্র দান করেন তিনি, যা আজও বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে আছে। সৈয়দ শাসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকের অন্যতম আব্বাস চরিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে কত চরিত্রই তো করেছেন তিনি। কিন্তু ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ তাঁকে যে গৌরব, যে পরিতৃপ্তি দিয়েছে তা মনে রাখতে হবে সারাজীবন। গত বুধবার তাঁর সঙ্গে আলোচনায় প্রসঙ্গটি তুলেই স্মৃতিতে ফিরে যান। আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, নূরলদীন নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের নয়। কোন একটি সময়ের নয়। সব সময়ের। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে চিরন্তন লড়াই, আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সমাজে দেশে বিশ্বে যত আন্দোলন, সেইসব আন্দোলনের প্রবল কণ্ঠস্বর নূরলদীন। বঞ্চিতদের নীপিড়িতদের সংগ্রামের ইতিহাসে নূরলদীন চিরকাল বেঁচে থাকবে। কালজয়ী এমন অসংখ্য সৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখবে সৈয়দ শামসুল হককে। জনপ্রিয় মাধ্যম সিনেমাতেও কাজ করেছেন সব্যসাচী। অনেকগুলো বাংলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন। ঢাকার সিনেমা সংশ্লিষ্টরা কথাগুলো তুলছেন এখন। বেরিয়ে আসছে অনেক নতুন তথ্য। মৃত্যুর পর তার লেখা গানগুলো বিশেষভাবে সামনে এসেছে। সরল উচ্চারণ ও ছন্দে তিনি বলেছেন গভীর জীবনবোধের কথা। কবির মৃত্যুতে গানগুলো যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে। জানা যাচ্ছে, তাঁর লেখা গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’, ‘যার ছায়া পড়েছে, মনের আয়নাতে’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’, ‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে ওগো শুধু মোরে’, ও ‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না’। অসংখ্যবার শোনা গান যে সৈয়দ হকের লেখা, জেনে অবাক হচ্ছেন শ্রোতা। যতদূর তথ্য, সিনেমার জন্য আরও অনেক গান লিখে গেছেন সৈয়দ শামসুল হক। নতুন করে কথাগুলো হচ্ছে। সৃষ্টির আলোয় সৈয়দ হককে দেখার চেষ্টা করছেন বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকার মানুষ।
×