ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন স্থবির ;###;আজ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও কাল বাস ধর্মঘট আহ্বান

চট্টগ্রাম বন্দর অচল ॥ প্রাইম মুভার ধর্মঘট

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

চট্টগ্রাম বন্দর অচল ॥ প্রাইম মুভার ধর্মঘট

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানির কন্টেনার পরিবহনে নজিরবিহীন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কন্টেনার পরিবহনে নিয়োজিত প্রাইম মুভার (ট্রেইলর) মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকা ধর্মঘটের চতুর্থ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। চার দিনে এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য অনেকটা একেবারেই নাকাল। কেননা, ইতোমধ্যেই ধর্মঘটের জের হিসেবে কন্টেনার সংরক্ষণে স্থান সঙ্কুলান করা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামীতে এ বন্দরে কন্টেনারবাহী জাহাজ ভেড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরজুড়ে ৩৬ হাজার টিইইউএস কন্টেনার ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে ৪০ হাজার ২শ’ টিইইউএসে উন্নীত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে এ সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে বলে জানানো হয়েছে। অপরদিকে, প্রাইম মুভার ধর্মঘটের প্রতি পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জানিয়ে কাল শনিবার থেকে চট্টগ্রামে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ও পরশু রবিবার থেকে বাস ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। এ ধর্মঘটের মূল এবং একমাত্র কারণ হিসেবে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি ও মেঘনা সেতু এলাকায় ওয়িং স্কেল (ওজন স্কেল) নিয়ে হয়রানির নানা অভিযোগ, যা নিয়ে প্রাইম মুভার মালিকরা দফায় দফায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোন সুফল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে গত সোমবার থেকে এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সে দিন থেকে টানা এ ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ধর্মঘট পরিস্থিতি নিরসনে সার্কিট হাউসে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে বৈঠক আহ্বান করা হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী এ বৈঠক নিষ্ফল হয়ে যায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক কোন বক্তব্য বা সিগন্যাল না আসায়। বৈঠকে মধ্যস্থতাকারী চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক শামসুল আরেফিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি সকল পক্ষের বক্তব্য শুনেছেন এবং মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি ও রফতানি পণ্যের চালান বিভিন্নভাবে পরিবাহিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান সুষ্ঠু ব্যবস্থা হচ্ছে মুভারযোগে কন্টেনারবোঝাই পণ্যের আনা-নেয়া। এফসিএল (ফুল লোড কন্টেনার) ও এলসিএল (লেস লোড কন্টেনার) পরিবহনে মুভারের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে কন্টেনার ও পণ্যের ওজন নিয়েই সড়ক ও জনপথ বিভাগের যত মাথাব্যথা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যে ওয়িং স্কেল রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ৩৩ টন ওজনের লরি বিনা চার্জে অতিক্রম করার সুযোগ রয়েছে, অন্যথায় নয়। বাড়তি হলেই টনপ্রতি অতিরিক্ত মাসুল গুনতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় কোন কোন লরিকে অতিরিক্ত ১০ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বাড়তি চার্জ দিয়ে পার পেতে হয়। এ বাড়তি চার্জ দিতে হচ্ছে মুভার মালিকদের। ফলে তারা আমদানিকারকের কাছ থেকে যে পরিমাণ ভাড়া পেয়ে থাকে তা থেকে বাড়তি চার্জ চলে যাচ্ছে। একদিকে আমদানিকারকরা যেমন এ চার্জ দিচ্ছে না, তেমনি ওয়িং স্কেল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরাও ছাড় দিচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানে এ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে না আসায় শেষ পর্যন্ত তা দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে আঘাত করেছে। যেদিন থেকে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে সেদিন থেকে আমদানি পণ্যবোঝাই কোন লরি যেমন বের হয়নি, তেমনি রফতানির কন্টেনার বিশেষ করে গার্মেন্টস পণ্যসামগ্রী নিয়ে কোন কন্টেনার বন্দরে প্রবেশ করেনি। ফলে এ প্রক্রিয়া পণ্যের জাহাজীকরণকেও আঘাত করেছে। ইতোমধ্যে এক হাজারেরও বেশি কন্টেনার না নিয়ে বিদেশী পতাকাবাহী তিনটি জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে। দুয়েকদিনের মধ্যে আরও জাহাজ ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, এ অচলাবস্থা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা টাকার অঙ্কে হিসাব করে বলা মুশকিল। নির্দিষ্ট সময়ে রফতানি পণ্য প্রেরণ করা না গেলে বিদেশী আমদানিকারকরা যেমন বিগড়ে যায়, তেমনি অনুরূপভাবে আমদানি পণ্য বেরিয়ে না এলে দেশের পণ্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। তবে এখনও ওই পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কন্টেনার রাখার ইয়ার্ডগুলোর কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এ্যাডমিন এ্যান্ড প্ল্যানিং) জাফর আলম এ পরিস্থিতিতে শঙ্কা প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে জানান, বন্দরের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। ইয়ার্ডে কখনই কন্টেনারের সংখ্যা ৪০ হাজার অতিক্রম করেনি। কর্মসূচী অব্যাহত থাকায় এবং এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ায় পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা চিন্তা করাও কঠিন। তিনি জানান, স্বল্প পরিসরে কিছু কন্টেনার বন্দর থেকে বের হচ্ছে। কিন্তু প্রাইম মুভারের মাধ্যমে যেগুলো অফডকে আনা-নেয়া করা হয় সেগুলোর পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ। স্থান সঙ্কুচিত হতে হতে একপর্যায়ে জাহাজ থেকে নামানো কন্টেনার রাখার জায়গাও হয়ত থাকবে না। জাহাজগুলোকে হয় ভাসমান থেকে মাসুল গুনতে হবে, নয়ত কন্টেনার না নামিয়ে ফেরত যেতে হবে। উল্লেখ্য, সোমবার থেকে শুরু হওয়া এ ধর্মঘটের চতুর্থ দিন অতিবাহিত হয় বৃহস্পতিবার। এ চার দিনে বন্দর অভিমুখে কন্টেনার পরিবহন বন্ধ থাকায় অনেক জাহাজ বন্দর ছেড়েছে রফতানির কন্টেনার ছাড়াই। একই ভাবে আমদানি করা শিল্পের কাঁচামালবোঝাই অনেক কন্টেনার পড়ে আছে বন্দর অভ্যন্তরে। বেসরকারী ১৬টি অফডকেও সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। সেখানে কোন কন্টেনার আসছে না এবং সেখান থেকে বন্দরের দিকে কন্টেনার যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ভয়াবহ জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্দরে কন্টেনার জট মাঝেমধ্যে হলেও এমন পরিস্থিতি আগে কখনও সৃষ্টি হয়নি। সঙ্কট উত্তরণে বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক হয় আন্দোলনকারী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দের। এতে উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বেসরকারী আইসিডি মালিকদের সংগঠনের প্রতিনিধি, সড়ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিজিএমইএ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা। কিন্তু দীর্ঘ এ বৈঠক শেষ হয় কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই। আন্দোলনকারীরা ওজন নিয়ন্ত্রণে আরোপিত বাড়তি চার্জ বা জরিমানার প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকলের বক্তব্য গ্রহণ করে তা সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বরং কর্মসূচী অব্যাহত থাকলে তাতে পুরো বন্দরের কার্যক্রম স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে সাংঘাতিকভাবে উৎকণ্ঠিত শিল্প মালিক, রফতানিকারক ও আমদানিকারকরা। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার ইয়ার্ডে কন্টেনারের সংখ্যা ৪০ হাজার ২৫০ টিইইউএস। অথচ ধারণক্ষমতা ৩৬ হাজার ২৫৯। যেখানে ইয়ার্ডের অন্তত ৩০ শতাংশ খালি রাখা প্রয়োজন সেখানে এখন রয়েছে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় চার হাজার বেশি। কন্টেনারের স্তূপ বাড়তে থাকায় ভেতরে যন্ত্রপাতি আনা-নেয়ায়ও সমস্যা হচ্ছে। জাহাজ থেকে কন্টেনার নামিয়ে রাখার জায়গা একেবারেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচল হয়ে যেতে পারে চট্টগ্রাম বন্দর। বেসরকারী কন্টেনার ডিপো এ্যাসোসিয়েসনের সচিব রুহুল আমিন সিকদার জানান, মঙ্গলবার রাত বারোটা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টার জন্য কর্মসূচী শিথিল করেছিল প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। ফলে সে রাতে অফডকগুলো থেকে কিছু কন্টেনার গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এতে জাহাজগুলো রফতানির কন্টেনার নিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু ওই একদিনের জন্য শিথিল করে আবারও আগের অবস্থানে আন্দোলনকারীরা। ফলে বুধ ও বৃহস্পতিবার রফতানির কন্টেনার বন্দরে আসতে পারেনি। মঙ্গলবার আট শতাধিক কন্টেনার ফেলে রেখে জাহাজ বন্দর ছেড়ে যায়। এ অবস্থাকে অত্যন্ত ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুরো আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৬টি অফডকের মধ্যে কন্টেনার আনা-নেয়ার কাজটি আমদানি-রফতানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারাদেশ থেকে রফতানি পণ্য অফডকগুলোতে আসে। সেখান থেকে প্রাইম মুভারে কন্টেনার যায় বন্দরে। এরপর হয় জাহাজীকরণ। মুভার বন্ধ থাকায় থমকে গেছে রফতানি। একই ভাবে আমদানির কাঁচামালও খালাস নিতে পারছেন না আমদানিকারকরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শতভাগ রফতানিমুখী পোশাক খাত। বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মঈনউদ্দিন আহমেদ মিন্টু বলেন, বন্দরে ছোট-বড় অনেক সমস্যা আগেও হয়েছে। কিন্তু এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। পুরো আমদানি-রফতানি খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে এ কর্মসূচীর কাছে। তিনি জানান, বিভিন্ন অফডকে কন্টেনারগুলো পড়ে আছে। শিল্প মালিকরা পড়েছেন বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে। এয়ারশিপমেন্ট করতে হলে ব্যয় হবে অনেক বেশি। আবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পাঠাতে না পারলে অর্ডার বাতিল হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। আমদানির কন্টেনারগুলো খালাস করতে না পারলে বন্ধ হয়ে যাবে কারখানা। কারণ, ওই কন্টেনারগুলোতে রয়েছে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। এদিকে, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিকদের ডাকা চলমান ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিকদের কর্মসূচী। শনিবার থেকে চট্টগ্রামে তারাও এ কর্মসূচীতে যাচ্ছে। তাদেরও অভিযোগ, ওজন নিয়ন্ত্রণের নামে মহাসড়কে স্থাপিত স্কেলগুলোতে চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের হয়রানি করা হয়ে থাকে। নির্যাতন ও মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। অতিরিক্ত পণ্যের জন্য বাড়তি চার্জ বা জরিমানা পরিশোধ করলে তা আমদানিকারকের সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় করা হবে এ বিষয়টিও আন্দোলনকারী পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের অন্যতম ইস্যু হিসেবে রয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রাথমিক একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে প্রাইম মুভারযোগে পরিবাহিত কন্টেনারের সর্বোচ্চ ওজন নিয়ে যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা শিথিল করে আরও বাড়ানোর চিন্তাভাবনা হয়েছে। আজ বা কালের মধ্যে নতুন কোন ঘোষণা আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
×