ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর খুনী ও সাজাপ্রাপ্ত সব যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে সংসদে প্রস্তাব পাস ॥ সম্পত্তি বাজেয়াফত

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর খুনী ও সাজাপ্রাপ্ত সব যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে সংসদে প্রস্তাব পাস ॥ সম্পত্তি বাজেয়াফত

সংসদ রিপোর্টার ॥ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট আনিসুল হক দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের কোন সম্পত্তি এই স্বাধীন দেশে থাকতে পারে না, রাখার কোন অধিকার নেই। অতি দ্রুতই বঙ্গবন্ধুর খুনী এবং দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের নামে- বেনামে থাকা সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হবে। এই কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফতের প্রস্তাব করে আনীত বেসরকারী সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব নোটিসের জবাব দিতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন। নোটিসদাতা ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির এই প্রস্তাবটি সমর্থন করে বক্তব্য দেন নূরজাহান বেগম, মনিরুল ইসলাম, আবদুল মতিন, সানজিদা খানম ও ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়ার পর সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাঁদের সমর্থন জানান। আইনমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের সম্পত্তি বাজেয়াফত করতে আইনের কোন প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সম্পত্তি বাজেয়াফত করতে গেলে আইনের কিছুটা সংশোধনী আনতে হবে। আর যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদেরও কোন সম্পত্তি থাকতে পারে না। তাদের নামে থাকা সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হবে। এ লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে একটি বিল প্রস্তুত করা হচ্ছে। অবিলম্বেই এই সংসদে বিল এনে পাসের মাধ্যমে দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তিও বাজেয়াফত করা হবে। এ প্রসঙ্গে আইনগত বিভিন্ন বিধান বিশ্লেষণ করে আইনমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু সবসময়ই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে গেছেন। আর তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করেন বলেই প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের যে মুহূর্তে ফাঁসির দ- কার্যকর করা হয়েছে, সেই মুহূর্ত থেকে তাদের সকল সম্পত্তি তাদের উত্তরাধিকারের কাছে চলে গেছে। তাই তাদের সম্পত্তি বাজেয়াফত করতে হলে নতুন আইনের প্রয়োজন হবে। আমি দৃঢ়ভাবে দেশবাসীকে জানাতে চাই, এই আইন প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। খুনীদের সম্পত্তি বাজেয়াফত করতে গেলে কিছুটা সময় লাগবে। তবে এটুকু বলতে চাই, খুব শীঘ্রই আইনটি প্রণয়ন করা হবে। আর যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াফতের আইন প্রণয়নের কাজও শুরু হয়ে গেছে। আবেগজড়িত কণ্ঠে আইনমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বাঙালী জাতির হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, সেই রক্তক্ষরণ এখনও চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা যে কলঙ্কের তিলক এঁটে দিয়ে গেছে, খুনীদের ফাঁসির দ- কার্যকর এবং তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলেও সেই কলঙ্ক মুছবে না। যতদিন এদেশে আমরা বেঁচে থাকব, বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে- ততদিন এই রক্তক্ষরণ চলতেই থাকবে। কোন ডাক্তার সেলাই করে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারবে না। আইনমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের নৃশংস হত্যাকা-ের বিবরণের কিছুটা উক্তি তুলে বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের যে সকল আসামিদের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে, তাদের নামে-বেনামে থাকা সকল সম্পত্তি খুঁজে বের করার জন্য গঠিত একটি টাস্কফোর্স কাজ শুরু করেছে। চলতি বছরের ৩১ মে টাস্কফোর্সের বৈঠকে এ বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পলাতক খুনীদের ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। তবে অনেক সতর্কতার সঙ্গে করতে হচ্ছে, কেননা জানাজানি হলেই খুনীদের সম্পত্তি বেনামী করার চেষ্টা করা হতে পারে। আর এমন ঘটনা এদেশে অনেকেই ঘটেছে। তবে একথা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, অবিলম্বেই আইনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনী ও দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। বঙ্গবন্ধু খুনীদের ৬১ সাক্ষীর সাক্ষ্যর বিষয়টি তুলে ধরে এই প্রবীণ আইনজীবী বলেন, আইনমন্ত্রী হিসেবে আমাকে ‘কারণ’ উল্লেখ করে বক্তব্য দিতে হয়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের কথা বলতে গেলে আবেগ আসবে এটাই স্বাভাবিক। এই হত্যা মামলার ৬১ সাক্ষীর সাক্ষ্য কেউ পড়লে তিনি যদি মানুষ হন অবশ্যই তার চোখে পানি আসবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন এদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু নয়, শেখ মুজিব বলতে হবেÑ এটাও দেখেছি। কিন্তু চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুর নাম বাঙালীর হৃদয় থেকে কেউ মুছতে পারেনি, পারবেও না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী সদ্য প্রয়াত মহিতুল ইসলামের সাক্ষ্যর কিছু অংশ তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে প্রথমে দোতলা থেকে বঙ্গবন্ধু নিচে ফোন করে মহিতুল ইসলামকে বলেন সেরনিয়াবাতকে (আবদুর রব সেরনিয়াবাত) ফোন কর। ফোন করেও পাচ্ছিলাম না। তখন বঙ্গবন্ধু নিজেই নিচতলায় নেমে এসে বলেন সেরনিয়াবাতকে না পারলে ক্যান্টনমেন্টে শফিউল্লাহকে (তৎকালীন সেনাপ্রধান কেএম শফিউল্লাহ) ফোন কর। এ সময় খুনীরা চলে আসে। নিচতলায় তখন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল ঘাতকদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি শেখ কামাল, আমি বঙ্গবন্ধুর ছেলে। তখনই খুনীরা পর পর তিনটি গুলি করে শেখ কামালকে হত্যা করে। এরপর দোতলায় উঠে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সকল সদস্যকে নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যা করে খুনীরা। তাই এসব খুনীদের কোন সম্পত্তি স্বাধীন দেশে থাকতে পারে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফতের দাবি জানিয়ে বেসরকারী সিদ্ধান্ত প্রস্তাব উত্থাপনকারী বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি বলেন, জাতির পিতা আমাদের ভাষা, স্বাধীনতা, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে গেছেন। কিন্তু খুনী মোশতাক-জিয়ারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ইয়াহিয়া-ভুট্টো কবর খুঁড়েও বঙ্গবন্ধুর গায়ে হাত দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি, যা করেছে মোশতাক-জিয়ারা। ছোট শিশু রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। এই ভয়াল হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব সভ্যতার কোথাও ঘটেনি। তিনি বলেন, হামলার সময় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের একজনও ঘাতকদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক ও জিয়ারা খুনীদের বিচার না করে উল্টো পুরস্কৃত করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমান যে জড়িত ছিলেন তা মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণেই বেরিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি এই জিয়াউর রহমান। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীন দেশ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ারা প্রটেকশন দিয়েছে, আমি তাদের ঘৃণা জানাই। তাই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের স্বাধীন বাংলাদেশে কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকতে পারে না, থাকতে পারবে না। অবিলম্বে খুনীদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াফত করার দাবি জানান তিনি।
×