ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

কাশফুল কন্যার জন্য প্রার্থনা

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কাশফুল কন্যার জন্য প্রার্থনা

মহান স্রষ্টার কাছে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এ জন্য যে, তিনি বাঙালী জাতিকে এমন এক মহান ব্যক্তি উপহার দিয়েছেন যাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা, সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা, আবেগের মায়াবী ও বজ্রকঠিন অঙ্গীকারের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যিক প্রেরণায় এক রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন। দীর্ঘ তিন হাজার বছর বাংলার এই জনপদের সমাজ-ইতিহাস চিত্রিত হয়েছে আর্য, দ্রাবিড়, রাঢ়, মৌর্য, তুর্কী, পাঠান, মোগল, ইংরেজ ও পাকিস্তানের চরম শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের লোমহর্ষক ঘটনাপ্রবাহ দিয়ে। এ তিন হাজার বছরের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই যিনি সর্বপ্রথম স্বাধীন এবং বাঙালী রাষ্ট্রনায়ক, তিনি হচ্ছেন মহাকালের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, রাজনীতির মহাকবি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বীয় মেধা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতাসমৃদ্ধ এবং অসাধারণ মানবিক গুণাবলীর মোড়কে আপামর বাঙালীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে পরবর্তীকালে শুধু বাঙালীর বঙ্গবন্ধুই নন, সমগ্র বিশ্বের কাছে ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিব হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরই সুযোগ্য তনয়া বিশ্ববরেণ্য নন্দিত রাজনীতিক অনন্যসাধারণ সামাজিক, মানবিক ও রাষ্ট্র দর্শনের প্রবক্তা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। বাংলার ঋতুসমূহের শ্রেষ্ঠতম এ শরতের শুভ্রতা-সৌম্য-পবিত্রতা, শিউলিমাখা প্রকৃতির অনন্য সুন্দর কাশফুলের সৌরভে অত্যুজ্জ্বল প্রতীক হয়ে যাঁর জন্ম, বিশ্ব বিধাতার দরবারে তাঁর মঙ্গল প্রার্থনার জন্য এই স্বল্প মাত্রার নিবন্ধের উপস্থাপনা। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁকে জন্মদিনের বিলম্বিত ফুলেল শুভেচ্ছা। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর অতি প্রিয় ও আদরের ‘হাচু’ এবং কামালকে নিয়ে বর্ণিত বক্তব্যে ত্যাগ, মনোকষ্ট ও প্রিয়জন থেকে বিচ্ছেদ থাকার যে মর্মবেদনা প্রতিফলিত হয়েছে তা প্রত্যেক হৃদয়বান মানুষকে ব্যথিত ও স্পর্শ করে। সেইদিনের অতি চঞ্চল ও আদরের ‘হাচু’ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে বিশ্ব রাজনীতিতে আজ বিশেষ মর্যাদার আসনে সমাসীন হবেন জাতির পিতা নিজেও কি তা জানতেন! এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, জাতির পিতার হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করে এই মহীয়সী নারী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে যেমনিভাবে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, একইভাবে বিশ্ব রাজনৈতিক পরিম-লে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান বিশ্ব রাজনীতিতে নারীর রাজনৈতিক অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে স্বীয় প্রতিভা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা, সততা ও অসীম সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখে বিশ্ব রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আজ এক অসাধারণ উঁচুমার্গের আসনে অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু তনয়া বাঙালীর হৃদয়ের শ্রদ্ধা-ভালবাসা, আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক শেখ হাসিনা। জাতি পেয়েছে জাতির পিতা, পেয়েছে বঙ্গমাতা। সঙ্গে পেয়েছে বাংলাদেশের সকল জননীর অতি আদরের কাশফুল কন্যা, প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে যে গভীর অন্ধকার, নষ্ট, বিকৃত ও বিভ্রান্তির রাজনীতি চালু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাকে সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে সামরিক জান্তার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিল, তা থেকে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়-নির্ভীক নেতৃত্বে এক দিশাহীন জাতিকে সৎ, সুন্দর, কল্যাণ-আলোকে প্রজ্বলিত করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির এ পর্যায়ে নিয়ে এসে জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে এক বিস্ময়কর উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। প্রায় ১০ বার কুচক্রীদের চক্রান্তের শিকার মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশের বৃহত্তম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের ভার হাতে নিয়ে সকল কূপম-ূকতা, অনগ্রসরতা, সাম্প্রদায়িকতা, অমানবিকতা, অনৈতিকতা অর্থাৎ সকল ধরনের অশুভ শক্তিকে নিধন করে জাতির পিতার হত্যার বিচার এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও জনগণের প্রত্যাশিত এ মহৎ কার্যক্রম অব্যাহত রেখে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে বিশ্ব দরবারে এক অবিনশ্বর ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া সেই নেত্রী আজ বিশ্বখ্যাত নারীনেত্রী ও সুদক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, মার্গারেট থেচার, লেডি ন্যান্সি এ্যাস্টর, লিওনর সুলিভ্যান, মার্গারেট চেজ স্মিথ, মার্থা গ্রিফিথস, এলা গ্র্যাসো, শার্লি চিশল্ম, বার্নাডেট ডেভলিনের একই কাতারে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছেন। ক্ষেত্র বিশেষে এঁদেরকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ধরিত্রী, সমুদ্র, সীমান্ত, মঙ্গা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য বিজয়ী এ দূরদর্শী নেত্রীর যে দিকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশবাসী সকলে তা অবগত থাকলেও এ নিবন্ধে কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে আবার জনগণের স্মরণকে উজ্জীবিত করতে চাই। বিগত ৭ বছরের সফল রাষ্ট্র শাসনের ফলে অর্জিত প্রণিধানযোগ্য বিষয়গুলো হলো- বর্তমানে বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭০ বছর ১০ মাস ২৪ দিন (প্রায় ৭১ বছর), এফডিআই তথা বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিগত বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন, মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) তথা মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যু হারের নিম্নগামিতা, পুষ্টি-খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ১০ টাকা কেজি চাল প্রাপ্তির ব্যবস্থা, বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীকে ৩৩ কোটির মতো বই বিতরণ, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের অপরিসীম উদ্যোগ গ্রহণ, জঙ্গী-সন্ত্রাস দমনে সাফল্য, দারিদ্র্য-নিপীড়িত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো, ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বালানোর সর্বাত্মক সফল উদ্যোগ গ্রহণ, তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন, গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন ইত্যাদি। এছাড়াও শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার অকল্পনীয় উন্নয়ন সাধন, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশ্বে বিরল প্রায় ১২১ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়ন, বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে পহেলা বৈশাখসহ উৎসব আয়োজনে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎসবভাতা প্রদান, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিসহ দক্ষ, যোগ্য মানবসম্পদ উৎপাদনে শিক্ষা-ক্রীড়া-সংস্কৃতিকে সমন্বয় করে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাদর্শন উপহার, আন্তঃধর্মীয় সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন এবং সকল ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান মর্যাদার সঙ্গে ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদযাপনের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ সুরক্ষা ইত্যাদি বহুমুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এখন বিশ্ব পরিম-লে একজন সফল রাজনীতিক ও উন্নয়নের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। জনগণের সেবায় নিবেদিত ও দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এ মেধাবী, অনন্যসাধারণ মহীয়সী ও উদার নৈতিকতাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক রক্তের উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় নিজেকে তৈরি করেছেন একজন আদর্শ পিতা-মাতার আদর্শ সন্তান হিসেবে- এটাই সত্য। সামাজিক ও মানবিক শক্তির সমন্বয়ে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার আলোকে তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নের প্রতিটি জায়গায় সকল ষড়যন্ত্রকে কঠোরহস্তে দমন করে নিরলসভাবে নির্ভীকচিত্তে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন রেখে এগিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া, যে পতাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ হয়েছেন, ২ লাখ জায়া-জননী-কন্যা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সে পতাকা হাতে দেশরতœ এগিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন। এটি অত্যন্ত কঠিন উপলব্ধির বিষয়, এ মহান নেত্রীর বুকজুড়ে বাবা-মাসহ নিষ্পাপ কনিষ্ঠ ভাই রাসেলের নির্মম হত্যাকা-ের করুণ স্মৃতি, দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রসহ তাঁকে বারবার হত্যার অপচেষ্টা এ সবকিছু মাথায় নিয়েই মহান মুক্তিযুদ্ধের অমীয় চেতনায় অভিষিক্ত জাতির পিতার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় ‘রূপকল্প-২০২১’ ও ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নের পথে প্রচ- আত্মবিশ্বাসী নেত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালীর কাছে আজ এক সাহসী ঠিকানা। লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×