ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ব্যাংক ঋণনির্ভর উন্নয়ন নীতিই খেলাপী ঋণের প্রধান কারণ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ব্যাংক ঋণনির্ভর উন্নয়ন নীতিই খেলাপী ঋণের প্রধান কারণ

আজকের কলামটি একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গল্পটি বহুল প্রচলিত। হয়ত অনেকেই জানেন। যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি। গ্রামের বাজার, বহু লোকের সমাগম। চারদিকে হৈচৈ, ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাক। হঠাৎ দেখা গেল কয়েকজন লোক একজন ভদ্রলোককে বেধড়ক পেটাচ্ছে। চুল ধরে, হাত টেনে, কলার চেপে সমানে পেটাচ্ছে। পিটুনি খেয়ে এক সময় ভদ্রলোক মাটিতে পড়ে চিৎকার করে বলছে: বাঁচাও, বাঁচাও। এমন সময় কয়েকটা লোক নিতান্ত দয়াপরবস হয়ে এগিয়ে এল এবং পিটুনিদাতাদের জিজ্ঞেস করল, আপনারা এই লোকটাকে এভাবে পেটাচ্ছেন কেন? ক্রুদ্ধ হয়ে একজন বলল, ব্যাটা টাকা ধার নিয়েছে, এটা ফেরত দিচ্ছে না। এবার অসহায় পিটুনি খাওয়া লোকটাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আসলেই কী আপনি টাকা ধার নিয়েছেন। জবাব- হ্যাঁ। পরিশোধ করছেন না কেন? উত্তর : আজকে যেভাবে ফেরত চাইছে এভাবে তো আগে তারা চায়নি। ঋণ প্রদান ও টাকা ফেরত পাওয়া সংক্রান্ত এই গল্পটির কথা মনে পড়ল ‘বিআইবিএম’ (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট) কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক এক সেমিনারের একটি প্রতিবেদন পাঠ করে। সংশ্লিষ্ট সেমিনারটিতে, খবরে দেখলাম, ব্যাংকের নানা সমস্যার ওপর প-িত ব্যক্তিগণ গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। এসবের ওপর নানা আলোচনা হয়েছে, নানাজন নানা সুপারিশ করেছে। এসব পাঠ করে দেখলাম ও বুঝলাম ব্যাংকের সমস্যা খুব বেশি একটা নেই। প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে ‘খেলাপী ঋণ’ (শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ) যার সম্পর্কে বাংলাদেশে আলোচনা হচ্ছে কমপক্ষে বছর ত্রিশেক ধরে। অন্তত দুইবার তো খেলাপী ঋণ গ্রহীতাদের নাম সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। খেলাপী ঋণের ওপর ত্রিশ বছরে রিপোর্ট হয়েছে, লেখা হয়েছে হাজার হাজার। সমস্যার জটিলতা, গভীরতা ইত্যাদি বেড়েছে ছাড়া কমেনি। উন্নয়নের পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালান, জমি দখল, বন ধ্বংস, নদী দখল ইত্যাদি যেমন বেড়েছে, তেমনি খেলাপী ঋণও আকারে-প্রকারে বেড়েছে। এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? হতাশাজনক একটা উত্তর দিই, পাঠকদের কাছে মাফ চেয়ে। যতদিন ব্যাংক ঋণের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে দেশের শিল্পায়নের প্রচেষ্টা চলবে ততদিন খেলাপী ঋণের সমস্যা মিটবে না বলেই আমার বিশ্বাস। এই সমস্যা শুধু আমাদের নয়। চীন ও ভারত আমাদের সাথী ও সমব্যথী। বাকিদের কথা নাই বা বললাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো ৮-৯ বছর আগে ট্রিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ডলার ঢেলে ব্যাংকগুলোকে খেলাপী সমস্যা থেকে মুক্ত করেছে। এর জন্য ওবামার সমালোচনা আজও করা হয়। গত ২০ সেপ্টেম্বরে একটি ‘বিজনেস ডেইলিতে’ একটি স্টোরি পড়লাম। এতে বলা হয়েছে, বিগত তিন বছরে চীন ৩০০ বিলিয়ন ডলার ব্যাংক ঋণ ‘রাইট অফ’ করেছে। বাংলাদেশের টাকায় তা কত হয় হিসাব করে নিন পাঠকরা (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি)। চীনের ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিশ্বের সবাই উদ্বিগ্ন। চীনের ‘শ্যাডো ব্যাংকিং’-এ কী ঘটছে তা খোদ চীন সরকারও জানে না। ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অবস্থাও একই রকম। বিজয় মালব্য নামের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক ভারতীয় ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ভারত ছেড়ে পালিয়েছে। দেশের খবরের কাগজগুলোতে প্রতিদিন ব্যাংকের ‘লড়াদশার’ খবর ছাপা হচ্ছে। ‘ব্যাংক ফিন্যান্স’ নির্ভর উন্নয়নের এই দশা বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের। বাকিদেরও তাই। এসব বলার অর্থ কী আমি আমাদের দেশের খেলাপী ঋণ গ্রহীতাদের সমর্থন করছি? মোটেও না। আমি বরং এই সমস্যার দ্রুত সমাধান চাই, টেকসই সমাধান চাই। এর জন্য আমার প্রথম প্রস্তাব- আমাদের শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ীদের স্টক একচেঞ্জে যেতে বলা হোক। তারা ব্যাংক-ফিন্যান্স নিক। কিন্তু প্রধানতম ফিন্যান্সের উৎস হবে শেয়ারবাজার। এতে ব্যাংকের বোঝা কমবে। ব্যবসায়ীদের ‘কস্ট অব ফান্ড’ হ্রাস পাবে। ব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ কমবে? এই প্রস্তাব কার্যকর হবে কী? দেশে প্রায় দুই লাখের মতো কোম্পানি আছে। এর মধ্যে ৩০০-৪০০টিও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নয়। বাকিদের মধ্যে যারা বড় তাদের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করুন। আমার সন্দেহ আছে এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে কীনা। দীর্ঘমেয়াদী এই পদক্ষেপের পাশাপাশি আরেকটি স্বল্পমেয়াদী আইনী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সুপারিশ করা যাক। কৃষি ঋণের টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিবছর ব্যাংকগুলো সার্টিফিকেট মামলা করে মিডিয়ার (পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি)-এর অধীনে শত শত গরিব কৃষককে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে চালান দেয়। গরিব ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে দশ-বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে যদি সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্র এত নির্দয় হতে পারে, কর্কশ হতে পারে তাহলে ‘ঋণ খেলাপ’কে ফৌজদারি অপরাধ (ক্রিমিন্যাল অফেন্স) বলে চিহ্নিত করতে আপত্তি কোথায়? নিবন্ধ শুরুর সময় যে গল্পের কথা বলেছি সেই মতো কড়া ও নির্দয় পদক্ষেপ আদালতের মাধ্যমে নিতে আপত্তি কোথায়? শত শত কোটি, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে বিদেশে ব্যবসা, শিল্প করা হবে আর ব্যাংক ভুগবে খেলাপী সমস্যায় এটা কীভাবে হয়। ব্যাংকের খেলাপী, অথচ ব্যবসায়ী দুবাইয়ে ব্যবসা করেন তাকে ‘ইন্টারপোলের’ মাধ্যমে কেন ধরে আনা যাবে না? এর জন্য দরকার আইনী সংস্কার, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের ব্যবসায়ীদের প্রতি অনেক উদারতা দেখানো হয়েছে। তারা ব্যাংকের উদারতায় ‘ক্যাপিটেল ফরমেশন’ যা করার, পুঁজি যা করার তা করেছেন এখন ব্যাংকের আর উদারতার প্রয়োজন নেই। প্রচুর ক্যাপিটেলওয়ালা বঙ্গবাসী এখন দেশে আছে। অতএব ঋণের টাকা আদায়ে কঠোরতা অবলম্বন করলে অপরাধ কিছু হবে না। এই ব্যবস্থা কী হবে? আমি নিশ্চিত নই। তৃতীয় প্রস্তাব ‘আদালত’ নিয়ে। ব্যাংকের টাকা আদায়ের আইন হচ্ছে ‘অর্থঋণ আদালত’। খেলাপী ঋণের (শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ) বিভিন্ন স্তর আছে। যখনই তা চূড়ান্ত পর্যায় অর্থাৎ ‘ব্যাড এ্যান্ড লসে’ পরিণত হলো তখন এই ঋণের বিপরীতে পুরো সঞ্চিতি (প্রভিশন) রেখে ঐ ঋণ অবলোকন করে মামলা করতে হয়। এই পর্যায়েই আসে ‘রিটের’ কথা। একপর্যায়ে বড় বড় গ্রাহক উচ্চতর আদালতে যান, রিট করে সবকিছু আটকে দেন। বেসরকারী ব্যাংক মালিকদের শীর্ষ নেতারাও তাই করছেন। এর থেকে মুক্তি কোথায়? বেঞ্চের অভাব, বিচারকের অভাব। দুর্ভাগা এই দেশ। এক হাজার টাকা ব্যাংক সুদ পেলে সরকার ১ হাজার ৫০০ টাকা উৎসে আয়কর কেটে নেয়, অথচ হাজার হাজার কোটি অনাদায়ী টাকা আদায়ে আইন মন্ত্রণালয় অধিকতর বেঞ্চ, অধিকসংখ্যক বিচারক নিয়োগের ব্যবস্থা করে না। গত দুই দশক ধরে এটা দেখে আসছি। দৃশ্যমান কোন উন্নতি দেখি না। একেকটা মামলা সোনার হাঁস। রায় হলেই হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়Ñ কিন্তু এর ব্যবস্থা নেই। আগামী দিনে কী এই ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হবে? আমার সংশয় আছে। বিদ্যমান বাস্তবতাতেই সংশয় প্রকাশ করছি। এরপরের প্রস্তাব নতুন কিছু নয়। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান অনুশাসনের মধ্যেই আছে। বলছি বড় ঋণের কথা। সব ব্যাংকে, বিশেষ করে সরকারী ব্যাংকগুলোর ওপর বড় ঋণের ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ দেয়া আছে। কিন্তু তা পালিত হচ্ছে না। যারা তা পালন করে না সেই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীর কোন বিচার নেই। তাদের জবাবদিহি করা হয় না। অথচ কে না জানে বড় বড় গ্রাহক আজকে ব্যাংকের বড় বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ছোট ছোট ঋণ গ্রহীতা ব্যাংকের টাকা নিয়মিত পরিশোধ করে। তাদের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপী খুবই কম। মজা হচ্ছে ব্যাংকারা তাদের ঋণ দেয় না, দিতে চায় না। এটা কোন গবেষণার বিষয় নয়। ব্যাংকাররা জানে। সাধারণ মানুষ তো জানেই। ঠিক পাকিস্তান আমালের ব্যাংকারদের মতো আজকের দিনের ব্যাংকারদের দৃষ্টিও বড় বড় গ্রাহকের প্রতি। বড় বড় গ্রাহককে নিয়েই টানাটানি। এতে ‘টার্গেট’ পূরণ হয়। শাখার লাভ দ্রুত হয় (পরে অবশ্য খেসারত দিতে হয়)। এই টানাটানি ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশ করছে। কিছু প্রধান নির্বাহী তার শাখা প্রধানকে অযৌক্তিক টার্গেট দিয়ে ব্যবসা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। টার্গেট বেশ কিছুটা পূরিত হয়। তিন-চার বছর পর বোঝা যায় কী সর্বনাশ হয়েছে। এই অনৈতিক প্রতিযোগিতা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। নজর দেয়া দরকার ছোট ঋণে। ‘এসএমই’ ফিন্যান্সিংয়ে ফাঁকিবাজি আছে। এটা বন্ধ করে দশ-বিশ লাখ, চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ, এক-দুই কোটি, পাঁচ-দশ কোটি টাকা পরিমাণের ঋণের ব্যবস্থা দরকার। ‘বৃহৎ ঋণের’ সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারিত করে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা দরকার। বড়দের ‘স্টক একচেঞ্জে’ যেতে বাধ্য করা দরকার। পরিশেষে একটা কথা বলব। ব্যাংকে ব্যাংকে ‘চেয়ারম্যান-এমডি’ এবং প্রভাবশালী দু’একজন পরিচালকের একটা ‘নেক্সাস’ আছে। এতে সামিল কতিপয় কর্মকর্তা। সরকারী ব্যাংক হলে তাদের যোগাযোগ ব্যাংকিং মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। তারা ইচ্ছামতো পদোন্নতি পান, তাদের পদায়ন হয় ইচ্ছামতো। এই ‘প্রসেসে’র ‘বেনিফিসিয়ারি’ ‘সিবিএ’ (কালেকটিভ বার্গেইনিং এজেন্ট) নেতারা যাদের কথা কেউ আলোচনা করে না। অথচ তাদের অঙ্গুলি হেলনে ফাইল নড়ে সরকারী ব্যাংকে। এই ‘নেক্সাস’টা বাংলাদেশ ব্যাংককে ভাঙতে হবে। এর জন্য আইনী পদক্ষেপ ও বিধিমালা যেমন দরকার, তেমনি দরকার হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করতে পারে। এই ক্ষমতা ব্যবহার অবিলম্বে বেশি করে শুরু হোক। আর নজর রাখা হোক চেয়ারম্যানদের ওপর। অনেক ক্ষেত্রে ‘চেয়ারম্যানরা’ স্বৈরাচারী হয়ে যাচ্ছেন। এক ব্যাংকে চেয়ারম্যানকে নিয়ে তুলকালাম কা- ঘটে গেছে ‘বেসিক ব্যাংকের’ পূর্বতন ‘স্বনামধন্য’ চেয়ারম্যান যাতে ব্যাংকিং খাতে আর জন্মলাভ না করে তার দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখা হোক। হবে কী এই ব্যবস্থা? নিশ্চিত নই আমি। পাঠকরা প্রশ্ন করতে পারেন আমাকে। আমি প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণেই সংশয় প্রকাশ করেছি এই নিবন্ধে- কেন? অভিজ্ঞতা বড় খারাপ। চারদিকে এক শতাংশ লোকের যে অত্যাচার দেখছি ৯৯ শতাংশের ওপর তাতে ভরসা পাই না। ভরসা পান না বারাক ওবামাও। জাতিসংঘে তার বিদায়ী ভাষণে এই ‘ডিভাইড’-এর কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করেছেন উগ্র বৈষম্যের কথা, বলেছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংস্কারের কথা। বাংলাদেশে কী এই সমস্যা সমাধানের সূত্রপাত হবে? ব্যাংকগুলোকে বৈষম্যের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের অব্যাহত চেষ্টা কী বন্ধ হবে! লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×