ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হালচাল ॥ আকিল জামান ইনু

মানুষ কেন সিনেমা বিমুখ!

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মানুষ কেন সিনেমা বিমুখ!

হতাশায় নিমজ্জিত বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সব মহল, হতাশ হলমালিকরা আর সিনেমা চলাকালীন সারি সারি শূন্য আসন উপহাস করছে বাংলা চলচ্চিত্রকে দর্শক হতাশার বহির্প্রকাশ হয়ে। এক বাক্যে বললে এটিই বাংলাদেশে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্রের বাস্তবতা। সোনালি দিন হারিয়ে দুঃসময়ে পতিত বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ এখন মূলত উৎসবকেন্দ্রিক। অর্থাৎ ঈদ, পূজা পার্বণ কিংবা ভ্যালেন্টাইন ডে-কে ঘিরে ছবি মুক্তির প্রত্যাশা করেন নির্মাতারা। বিশেষ করে দুটি ঈদকে ঘিরে নতুন ছবি মুক্তির প্রতিযোগিতায় নির্মাতারা লিপ্ত হন । হল মালিকরাও নতুন ছবি মুক্তি দিয়ে আশায় থাকেন অন্তত ঈদে বিনোদনের ভিন্ন মাধ্যম হিসেবে দর্শকরা হলে আসবেন ছবি দেখতে। এবারের ঈদ-উল-আযহায় মুক্তি পাওয়া নতুন তিনটি ছবির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, নায়ক-নায়িকারা ফেসবুকে, ইউটিউবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ছবির প্রচারণার স্বার্থে সাফল্য দাবি করলেও, প্রকৃত চিত্র কি বলছে? প্রতিটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ঈদে তাদের নতুন ছবি মুক্তি দিতে সচেষ্ট থাকেন বাণিজ্যিক সাফল্যের প্রত্যাশায়। এবারের ঈদকে কেন্দ্র করে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর ব্যবসা নিয়ে আমাদের মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। চট্টগ্রাম, রাজধানী, খুলনা, বরিশাল কিংবা যশোরের বেশিরভাগ হল নতুন ছবি মুক্তি দিলেও দর্শকখরা কাটেনি। জেলা, উপজেলার হলগুলোর অবস্থা আরও করুণ সারা দিনে তিনটি শোতে ২১টি টিকেট বিক্রির উল্লেখ বোধকরি চিত্রটি বোঝাতে যথেষ্ট। উপজেলা পর্যায়ের হলগুলো সারা বছর বন্ধ রেখে কেবল দু’ঈদে ছবি মুক্তি দিয়ে থাকে। রাজধানী-ঢাকার চিত্রও একই। দর্শক সাড়া কোথাও আশানুরূপ নয়। সময়ের সেরা তারকাদের উপস্থিতিও ছবির ব্যবসা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমতাবস্থায় এ কথা বলাই যায়, ডুবতে বসেছে নাঁও, চারদিকে ত্রাহি চিৎকার বাঁচাও-বাঁচাও। এখন প্রশ্ন একটাই, কে বাঁচাবে বাংলা চলচ্চিত্র? এই বাঁচানোর দায়িত্ব কার? এ কথা অনস্বীকার্য। চলচ্চিত্র একটি বাণিজ্যিক মাধ্যম। একটি সিনেমা নির্মাণে বড় অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ হয় আর পুঁজির ধর্ম অনুযায়ী বিনিয়োগকারী মুনাফা প্রত্যাশা করেন। এই বিনিয়োগ ফেরত ও মুনাফা নির্ভর করে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির হলে দর্শক উপস্থিতির ওপর। কারণ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ‘দর্শকই ভগবান’। সাধারণ দর্শক কোন চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন হলে ছবিটি উপভোগের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সিনেমা হলের ব্যবস্থাপনা, কারিগরি ও গুণগত মান, সুবিধাদিও বিবেচ্য। সিনেমা হল মালিক বা পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট নানা মহল ও দর্শকদের কাছ থেকে। আবার হল মালিকরাও তাদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। ও নিয়ে জল কেবল ঘোলাই হয়েছে। আর এর পরিণতি মোটেও সুখকর নয়। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলই তার প্রমাণ। বিপরীত পক্ষের হাজারো যুক্তির বিরুদ্ধে হল মালিকদের একটি কথাই যথেষ্ট। নিজস্ব অর্থের বিশাল বিনিয়োগের পর তারা দিনের পর দিন লোকসান গুনতে আগ্রহী নন। কারণ বাংলা সিনেমা দর্শক টানতে পারছে না। হঠাৎ দু’একটি ছবির বাণিজ্যিক সাফল্য কোনভাবেই তাদের সারা বছর লোকসান গুনতে উৎসাহী হবার কারণ হতে পারেনা। হল মালিকদের কাছে হলগুলোর আমূল সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। দীর্ঘদিন লোকসান গুনে পুঁজি হারানো এই মালিকরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী নন। অনেকেই হলগুলো ভাড়ায় পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এসব অস্থায়ী হল পরিচালকদের কাছে হল সংস্কার ও মান উন্নয়নে নতুন বিনিয়োগের প্রত্যাশা করা যায় কি? সরকার কিংবা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মহল যত বড় কথাই বলুন, কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে খুব কম। কার্যকর ব্যবস্থাটি হতে পারত হল পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারসহ মান উন্নয়নে বিনাসুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়া, সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুত সরবরাহসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান। সরকারী ব্যর্থতার একটি করুণ চিত্র বোধকরি ‘গুলিস্তান’ সিনেমা হল ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ যা একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থার অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছিল। ‘গুলিস্তান’ কেবল একটি হলই নয়, পঞ্চাশ দশকে নাগরিক রুচি গঠনে বিশাল অবদান ছিল এই হলটির। সিনেমা ঐতিহ্যের কেন্দ্র হিসেবেও এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব পালনে সরকার ব্যর্থ। সরকারের এই অবস্থান বিবেচনায় নিলে আমরা ব্যক্তি মালিকদের কাছে কি আশা করতে পারি?। আরেকটি বিষয় আমরা বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ যে, সিনেমা হলগুলো সাধারণত বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অবস্থিত মূল্যবান জমিতে গড়ে ওঠে। একজন মালিক যখন ঢাকার হলটি ভেঙ্গে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমে শত কোটি টাকা ব্যবসা করতে পারেন, সেখানে তিনি কেবল সিনেমা প্রেম থেকে হল চালিয়ে দিনের পর দিন কেন লোকসান গুনবেন? হলগুলোর পরিবেশ নিয়ে হাজারো অভিযোগ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার পাশাপাশি, আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঢাকার অন্তত ৮-৯টি হলে ভাসমান পতিতাদের অবাধ বিচরণ ও হিজড়াদের উৎপাতের বিষয়টি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা স্বীকার করেও বলা যায়, এ বিষয়ে আমরা কি কোন সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছি! বা চলচ্চিত্র শিল্প সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষ কি দলগতভাবে উপস্থিত হয়ে হলগুলোতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন? অনিশ্চিত ভবিষ্যত সামনে রেখে হল মালিকরা কতদিন লোকসান গুনবেন? মনে রাখতে হবে, কাউকে নির্দিষ্ট ব্যবসা পরিচালনায় বাধ্য করতে পারে এমন কোন আইন বিশ্বের কোথাও নেই। হল মালিকরাও বাধ্য নন হল পরিচালনায়। সুনির্মিত, সমসাময়িক গল্প নিয়ে তৈরি ভাল সিনেমা আকৃষ্ট করতে পারে দর্শক। আর হলে দর্শক উপস্থিতি হল কর্তৃপক্ষকে উৎসাহী করবে হল পরিচালনায়। এর কোন বিকল্প নেই। আমরা যারা হলে দর্শক কমে আসার কারণ হিসেবে স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট ও বিনোদনের সহজলভ্যতার কথা বলি, তাদের জন্য বাড়ির পাসের একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ভারতে স্যাটেলাইট চ্যানেলের, ইন্টারনেট বিনোদনের সুবিধা আমাদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু এ কারণে তাদের দর্শকরা হলে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে কি? ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার ব্যবসায়িক রিপোর্ট কি তা বলে? বড় পর্দায়, হল ভর্তি দর্শকের সঙ্গে সিনেমা উপভোগের যে অনুভূতি, তার যেমন কোন বিকল্প নেই, তেমনি বাংলা চলচ্চিত্রে সুদিন ফিরিয়ে আনতে সিনেমা হল ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনারও বিকল্প নেই। অভিযোগ করা হয়, ভাল সিনেমার অভাব দর্শককে হলবিমুখ করছে। অবশ্য ভাল সিনেমার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই তেমনি ‘দর্শক ভগবান’ কোন্ ছবিটি গ্রহণ করেন সিনেমা বাজার বিশ্লেষক অতি প-িতগণও এর কোন নিশ্চিত পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হন প্রায়শই। সিনেমা যেহেতু একটি সামষ্টিক উদ্যোগ, তাই নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে মানসম্পন্ন কাজ, ভাল গল্প, সমকালীন বাস্তবতাকে ধারণ করে নির্মিত একটি ছবিকে প্রাথমিকভাবে ভাল ছবির তকমা পেতে সাহায্য করে। এই ’সামষ্টিক কার্যক্রম’ বিষয়টি উঠে আসে ভাল ছবি নির্মাণে এবং এ ব্যাপারে সরকার পরিচালিত বাংলা ছবির কেন্দ্র বলে বিবেচিত এফডিসির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। চলচ্চিত্র উন্নয়নের স্বার্থে এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলেও কারিগরি সহায়তা প্রদান বা স্থান সঙ্কুলানের বাইরে এফডিসি কতটা ভূমিকা রেখেছে? এই কারিগরি সহায়তা প্রদানও প্রশ্নের বাইরে নয়। অপ্রয়োজনীয় অকেজো যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কর্তারা যতটা আগ্রহী ছিলেন, তার কিঞ্চিত আগ্রহ চলচ্চিত্র শিল্প উন্নয়নের জন্য থাকলে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। এই ‘সামষ্টিক’ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে গল্প লিখন, সংলাপ রচনা, স্ক্রীন প্লে, কোরিওগ্রাফার, মেকআপ, শিল্প নির্দেশক, শব্দ সংযোজন, পোশাক পরিকল্পনা, অভিনয় শিল্পী, পরিচালক প্রভৃতির জন্য মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদানে এফডিসি কি আদৌ ভূমিকা পালন করেছে? লেখার শুরুটা হতাশার হলেও আমরা বিশ্বাস করি, এই হতাশা সাময়িক। দুঃসময়ে কেবল ভালবেসে চলচ্চিত্রকে আঁকড়ে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে নতুন ভাবনা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যোগ হয়েছে নতুন প্রজন্মের একদল মেধাবী তরুণ। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আবার জেগে উঠবে বাংলা চলচ্চিত্র সিনেমা হলের সারি সারি আসন ভর্তি দর্শকের করতালিতে। এই ফাঁকে কোন এক মধ্যবিত্ত গৃহিণী হলে সিনেমা দেখতে এসে আবেগে কেঁদে বুক ভাসাবেন হাপুস নয়নে।
×