ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জনতা পার্ক- এক নতুন জগত- ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জনতা পার্ক- এক নতুন জগত- ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড

এমদাদুল হক তুহিন ॥ চার সারিতে বসে কাজ করছে উদ্যমী তরুণ-তরুণী। এদের দুই সারির অধিকাংশের হাতেই নথিপত্র। সেই তথ্য ইনপুট হয়ে সরাসরি চলে যাচ্ছে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে। একইভাবে পাশের দুই সারিতে যে তরুণীরা কাজ করছেÑ তাদের কানে হেডফোন। কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল। দিয়ে যাচ্ছে সার্ভিস।- ঠিক এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে দেশের প্রথম সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক জনতা টাওয়ারের নয় তলায়। শুধু তাই নয়- চার তলায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ চলছে নিত্য নতুন সফটওয়্যার তৈরিতে। উদ্যমী তরুণদের একদল কাজ করছে- ইস্কুল নামের একটি সফটওয়্যার উন্নতকরণে। মেডিক্যাল খাতকে ডিজিটাইজড করতে কাজ করে চলছে অপর আরেকদল তরুণ। রাজধানীর কাওরানবাজারের জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের অভ্যন্তরে এখন এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। প্রযুক্তি খাতে নিয়োজিত এসব কর্মীর হাত ধরে দেশ হচ্ছে ডিজিটাইজড, অর্জিত হচ্ছে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। সরকার ২০১৮ সালের মধ্যে আইসিটি খাতে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করতে চায়। খাতটির সঙ্গে বেসরকারীভাবে জড়িতদের প্রত্যাশা- তারা সরকারের নির্দিষ্ট টার্গেট ছাড়িয়ে যাবে। এ খাতে আয় হবে ১ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি! সফটওয়্যার পার্কের কার্যক্রম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি ও বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার জনকণ্ঠকে বলেন, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের কাজ দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে। ইতোমধ্যে জনতা টাওয়ারের স্পেস বরাদ্দ প্রায় শেষ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এ ব্যাপারে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে সফটওয়্যার শিল্পে প্রচুর কাজ হচ্ছে। ২০১৮ সালের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছেÑ আমার হিসেব বলছে আমরা তা অতিক্রম করব। সম্প্রতি সফটওয়্যার পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, ভবনটির কয়েকটি তলায় সফটওয়্যার নিয়ে কাজ চলছে পুরোদমে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ হচ্ছে ডাটা এন্ট্রির। মিষ্টভাষী তরুণীরা কাজ করছেন কল সেন্টারে। সফটওয়্যার পার্কে প্রস্তুত দুটি সভা কক্ষও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আইসিটি সংক্রান্ত নানা অনুষ্ঠান। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী আসছেন হরহামেশায়। খোঁজ নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের, ঘুরে দেখছেন প্রতিটি ফ্লোর। দাবি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এক কর্মকর্তার। জনতা টাওয়ারের নয় তলায় পুরোদমে কার্যকর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ফিফো টেক। বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় সরেজমিনে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। আর মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির উর্ধতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ১৩০ জন কর্মী প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন। এদের অধিকাংশই সবে শেষ করেছেন লেখাপড়া। তারা কল সেন্টার, ডাটা এন্ট্রি, বিপিও এবং ওয়েব ডেভেলমেন্ট নিয়ে কাজ করছে। ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স করেছেন তনিমা শারমিন। ২ মাস ধরে কাজ করছেন ফিফো টেকের কল সেন্টারে। জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে এই তরুণী বলেন, কল সেন্টারে কাজ করলে অনেক কিছুই শেখা যায়। যা কিছু শিখছি মনে হচ্ছে পরবর্তী সময়ে তা কাজে দিবে। এখানে কাজ করে নিজের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবারকে করতে পারতে পারছি সহায়তা। তিনি বলেন, বিপিও সামিটে গিয়েছিলাম। সেখানে নিজের জীবন বৃত্তান্ত জমা দিয়ে অনায়াসেই পেয়ে যাই এই চাকরি। আইসিটি সেক্টরের কর্মী হতে পেরে এই তরুণী উচ্ছ্বাসিতও। একই প্রতিষ্ঠানে ডাটা এন্ট্রির কাজ করেন সরকারী তিতুমীর কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স করা মোঃ রিপন আলম। বর্তমানে তার আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ। পেশায় তেমন কোন চাপ নেই। কাজের ধরন প্রসঙ্গে এই তরুণ জানান, তথ্যগুলো আমরা এক্সেলে ইনপুট করছি। সরাসরি ওয়েবে ইনপুট করতে হয়Ñ অনেক সময় এমন কাজও করি। ফিফো টেকের ফাইন্যান্স এ্যান্ড এডমিন ম্যানেজার আলা উদ্দিন জনি জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। প্রায় ১৩০ জন কর্মী এখানে কাজ করছে, এদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। তারা যখন লেখাপড়া শেষে আরও ভাল প্রতিষ্ঠানে কাজ করেনÑ তখন অনুভূতিটা হয় অন্য রকমের। অন্য রকম ভাল লাগার। তিনি জানান, সম্প্রতি গুলশান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে তারা এখানে এসেছে। এখানের পরিবেশ খোলামেলা। আগের চেয়ে জায়গা বেশি। কাজের ধরন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কল সেন্টারে মূলত আমরা অভ্যন্তরীণ কল বা টেলিসার্ভে নিয়ে কাজ করি। ভবিষ্যত প্রসঙ্গে তিনি জানান, সরকারীভাবে ২০১৮ সালের যে টার্গেট রয়েছেÑ আমরা সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছি। জনতা টাওয়ারের চার তলায় প্রযুক্তি নেক্সট নামক প্রতিষ্ঠানে কথা হয় সৈকত বণিকের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ওয়েভ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। এখানে কাজের পরিবেশ খুব ভাল। কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে লেখাপড়া করা এই তরুণ পেশা সম্পর্কে বলেন, এখানে অনেক কিছু শেখার আছে। ব্যাংকে কাজ করলে নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে কাজ করতে হতো। মূলত আমি শিখতে চাচ্ছিÑ তাই ওয়েব ভেভেলমপেন্ট নিয়ে কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, কেবল শেখার ইচ্ছে থাকলেই এই পেশায় ভবিষ্যত ভাল। শুধু আয়ের কথা চিন্তা করলে এক সময় না একসময় বিপর্যয় ঘটে। প্রযুক্তি নেক্সেটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা একরাম জনকণ্ঠকে বলেন, সফটওয়্যার নিয়েই আমাদের কাজ। কানেন্টিং স্টার্ট আপ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে এখানে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছি। এক বছরের মধ্যে আমাদের প্রকল্প শেষ করতে হবে। কাজের ধরন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্কুলগুলো ডিজিটাল করার লক্ষ্যে আমরা সফটওয়্যার তৈরি করছি। অনেক সময় শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অভিভাবকদের বেগ পোহাতে হয়। আমার একটি মোবাইল এপ্লিকেশন তৈরি করছিÑ যাতে করে অভিভাবক সহজেই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারবে। বর্তমানে কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী স্কুলে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটি কার্যকর রয়েছে। তিনি বলেন, আশা করছি এক বছরের মধ্যে সফটওয়্যারটি ব্যবহার যোগ্য করে তুলতে পারব। একই ভবনের চার তলায় ইন্টারেকটি আর ফ্যাক্টস নামের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কথা হয় কাজে ব্যতিব্যস্ত দেবাশীষ সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা এখানে ২ থেকে ৩ মাস আগে উঠেছি। সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। পেশা হিসেবে এ খাতের ভবিষ্যত অনেক ভাল। আর অভিজ্ঞতা যতো বাড়বে- কর্মীটির কাজের ধরন বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে আয়ও। তিনি বলেন, একজন ওয়েভ ডেভেলপার যখন কাজ শুরু করেন তখন তার আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। সামনেই এগিয়ে যেতে হবে। কঠোর পরিশ্রম ও মনোযোগের সঙ্গে কাজ করে গেলে সহজেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। কী নিয়ে কাজ করছেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তারা একটি মেডিক্যাল সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছেন। এক বছরের মধ্যে তা শেষ করে বাজারে ছাড়তে হবে। ব্যতিক্রম ধর্মী এই আইডিয়া প্রদানের কারণেই জনতা টাওয়ারে স্থান পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রসঙ্গত, বহুল আলোচিত এরশাদ ভবনেই গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম সফটওয়্যার পার্ক। আদালতের রায়ে জনতা টাওয়ার বাজেয়াফত হলে ভবনটি সরকারী সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় এবং সরকারী সম্পত্তিতে পরিণত হওয়ার ফলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে তা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১০ সালের ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় জনতা টাওয়ারকে দেশের প্রথম সফটওয়্যার পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের উদ্বোধন করেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ টেকনোলজি পার্কের সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করে। একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভবনটির আশপাশের পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। রাতে ভবনটির সামনে বসে যাচ্ছে কাঁচা বাজার। এতে কর্মীদের ফেরার পথে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। এছাড়া গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়। অভিযোগ, সফটওয়্যার পার্কের নিরাপত্তায় নেই কড়াকড়ি। এতে কেউ কেউ ভুগছেন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। ভবনটির সিঁড়িতে জমে আছে স্তূপাকারের ময়লা। সামগ্রিক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ১৬টি কোম্পানিকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫ থেকে ৬টি কোম্পানি কাজ শুরু করেছে। পুরো ভবনে আইটি সংক্রান্ত কর্মযজ্ঞ শুরু হতে আরও ১৫ দিনের মতো সময় লাগবে। অভিযোগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ভবনের সামনের পরিবেশ ব্যবহার উপযোগী ও জাঁকজমকপূর্ণ করতে তুলতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরাও কাজ করে যাচ্ছি, দ্রুত এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।
×