ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কলাবাগানে জোড়া খুনের পর আরও দুইজনকে হত্যার টার্গেট ছিল

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কলাবাগানে জোড়া খুনের পর আরও দুইজনকে হত্যার টার্গেট ছিল

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কলাবাগানে জোড়া খুনের পর আরও দুইজনকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের। টার্গেটকৃত ওই দুইজনের মধ্যে একজন একটি বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা। অপরজন লেখক। হত্যাকা- সংঘটিত করতে জঙ্গী সংগঠনটির একটি সিøপার সেল কাজও করছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সে তৎপরতায় ভাটা পড়ে। তবে পরিকল্পনা থেকে সরে যায়নি। জঙ্গী সংগঠনটি খুবই সীমিত পরিসরে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একটু সুযোগ পেলেই বড় ধরনের নাশকতা চালাতে পারে জঙ্গীরা। এজন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি বেশ কয়েকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যায় রিমান্ডে থাকা সবুরকে জিজ্ঞাসাবাদেও এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদকে। সবুর ঢাকা মহানগর পুলিশের পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গীর একজন। তাকে ধরিয়ে দিতে ২ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সে যাত্রাবাড়ীর ফরিদাবাদ মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। সবুর গ্রেফতারের আগে গত ২৬ জুন গ্রেফতার হয় ফরিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোঃ নাইম ওরফে সাইফুল ইসলাম ওরফে সাদ (৩০) ও রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের আল আরাফা ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক সোহেল আহম্মেদ ওরফে সোভেল (৩২)। তারা জঙ্গী সংগঠনটির দাওয়াতী সেলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। দুই শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গী সংগঠনটির সিøপার সেলের অনেক সদস্য সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফরিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক ছাড়াও কলাবাগানে জোড়া খুনের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী শিহাবের কাছ থেকেও সবুর সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। সবুর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যায় অংশ নিয়েছিল। এছাড়া সে ব্লগার অভিজিত রায় থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে তিনজনকে হত্যার চেষ্টা, ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু থেকে শুরু করে সর্বশেষ কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয় হত্যাকা- সম্পর্কে আগ থেকেই জানত। যদিও সবুর দীপন ছাড়া অন্য কাউকে হত্যায় অংশ নেয়নি বলে দাবি করেছে। সবুর যে সব ব্লগার খুন হয়েছে তাদের খুন হওয়ার বিষয়টি আগ থেকেই জানত। এমনকি পরবর্তী হত্যার টার্গেটে কারা রয়েছে, তাদের অনেকের সম্পর্কেই জানত। সবুরের সঙ্গে জঙ্গী সংগঠনটির সামরিক কমান্ডার বরখাস্ত হওয়া মেজর জিয়ার কয়েক দফায় দেখা সাক্ষাতও হয়েছে। মেজর জিয়ার আস্থাভাজন সবুর। জঙ্গী সংগঠনটির শূরা কমিটির সদস্যরা হত্যার তালিকা করে থাকে। সেই তালিকা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে মেজর জিয়াউল হক জিয়া। আর জিয়ার সঙ্গে সখ্যের সূত্র ধরেই সবুর আগাম অনেক কিছুই জানত। একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও ইউএসএআইডিতে কর্মরত থাকা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে বাসায় ঢুকে হত্যার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একটি সিøপার সেল আরও দুইজনকে হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল। কলাবাগানের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত শিহাবের জবানবন্দীতেও রিমান্ডে থাকা সবুরের কথা এসেছে। শিহাবের তথ্য মোতাবেক সবুর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কর্তৃক সব হত্যাকা-ের তথ্য আগে থেকেই জানত। এমনকি পরবর্তীতে কারা হত্যার টার্গেটে রয়েছে তাদের সম্পর্কেও আংশিক জানত সবুর। মূলত মেজর জিয়ার সঙ্গে সখ্যের সূত্র ধরে সবুর অনেক খবর আগাম জানত। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কলাবাগানের হত্যার পর আরও দুইজনকে হত্যার জন্য রেকি করছিল জঙ্গী সংগঠনটির একটি সিøপার সেল। টার্গেটকৃত দুইজনের মধ্যে একজন একটি সরকারী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা। তবে তিনি বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন, নাকি অবসরপ্রাপ্ত তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন, সবুরের দেয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সে তথ্যের সত্যতা মিলেছে। তথ্য মোতাবেক দুই ব্যক্তির নিরাপত্তা জোরদারসহ তাদের সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে তিনি ওই কর্মকর্তা ও লেখকের নাম পরিচয় তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করতে রাজি হননি। সবুরের বরাত দিয়ে এই কর্মকর্তা বলছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের গোয়েন্দা তৎপরতা একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। তারা খুবই সীমিত পরিসরে তৎপরতা চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে জঙ্গীরা তাদের তৎপরতা কমিয়ে দিয়েছে। তবে নজরদারি ও সাঁড়াশি অভিযান চলমান না রাখলে বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- বা চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- ঘটা বিচিত্র নয়। এজন্য বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপরও নজরদারি বাড়াতে হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কলাবাগানে হত্যা মিশনের পর আরও দুইজনকে হত্যার টার্গেট নিয়েছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ওই দুই ব্যক্তিকে ইতোমধ্যেই সাবধান করা হয়েছে। তবে তিনি তাদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করতে রাজি হননি। সবুরের দেয়া তথ্য মোতাবেক জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে কার্যক্রমে খানিকটা ভাটা পড়েছে মাত্র। তবে নজরদারি ও অভিযানে ভাটা পড়লে জঙ্গীদের দ্বারা আবারও নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটা বিচিত্র নয়। এজন্য তারা সতর্ক রয়েছেন। সাঁড়াশি অভিযানও অব্যাহত আছে।
×