ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যোগ দিচ্ছে না ভারত আফগানিস্তান ভুটান বাংলাদেশ ;###;নেপাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবার দুপুরে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করে

সার্ক শীর্ষ স্থগিত

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সার্ক শীর্ষ স্থগিত

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী নবেম্বরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। বুধবার নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র একথা জানিয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান ও ভুটান এবারের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ না নেয়ার ঘোষণার ফলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। বুধবার নেপালের কাঠম-ুু পোস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে অব্যাহতভাবে পাকিস্তান আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো ও হস্তক্ষেপ করায় ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান ও ভুটান এবারের সম্মেলনে অংশ না নেয়ার কথা জানানোর পরই সম্মেলন স্থগিতের বিষয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। সার্কের সদস্য এই চার দেশ ইতোমধ্যেই তাদের অপারগতার কথা সার্কের বর্তমান চেয়ার নেপালকে জানিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সম্মেলন পুরো বাতিল না করে স্থগিত করার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে নেপাল। এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান অব্যাহত হস্তক্ষেপ করায় ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা মঙ্গলবার সার্কের সভাপতি দেশ নেপাল ও সার্ক সচিবালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, নবেম্বরে অনুষ্ঠেয় ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দিচ্ছে না। কারণ হিসেবে আমরা বলেছি, আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক থাকা উচিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি রাষ্ট্রের অব্যাহতভাবে হস্তক্ষেপ এই সম্মেলন আয়োজনের জন্য উপযোগী নয়। পাশাপাশি আমরা বলেছি, সার্কের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা, কানেকক্টিভিটি ও সার্বিক সহযোগিতার বিষয় বিশ্বাস করে। সময় ও সুযোগ যখন আসবে বাংলাদেশ তখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে। সার্কে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে অন্য কোন দেশের সিদ্ধান্তের কোন সম্পর্ক নেই বলে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, সার্কে অংশ না নেয়ার বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করাটা নতুন কিছু নয়। পরিবেশ হলে বাংলাদেশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে, স্থান গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা যেটা বলেছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অব্যাহতভাবে পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করেছে। কাশ্মীরের উরিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় পাকিস্তনকে একঘরে করার যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের সঙ্গে এর কোন যোগসূত্র আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি সেটা বলব না। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব একটি সিদ্ধান্ত। আমরা সব সময় বলে আসছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার ও তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কখনও কারও সঙ্গে আপোস করেনি এবং করবেও না। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে কি না- এর জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। সম্প্রতি কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান ইস্যু ঘিরে দিল্লী ও ইসলামাবাদের মধ্যে এখন টানাপোড়েন শুরু হয়। বিশেষ করে কাশ্মীর উপত্যকায় সংঘর্ষে ঘটনায় ভারত বিরোধী প্রচার চালানোর কৌশল নেয় পাকিস্তান। আর পাল্টা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বেলুচিস্তান নিয়ে মন্তব্যের জেরে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। সেই সঙ্গে যোগ হয় ইসলামাবাদে সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ভারত-পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তিক্ততা। এর আগে সার্ক অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকেও যোগ দেননি ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আগেই কাশ্মীর ইস্যুতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আগে প্রস্তুতি হিসেবে সদস্য দেশগুলোর বিভিন্ন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়ে থাকে। আগস্টে প্রথম সপ্তাহে সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং যোগ দিয়েছিলেন। তবে ওই বৈঠকে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খানের সঙ্গে রাজনাথ সিংয়ের বাগ্বিত-া হয়। এদিকে দিল্লী-ইসলামাবাদের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যুতে টানাপোড়েনের আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যেও টানাপোড়েন চলে আসছিল। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান শুরু থেকেই নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েও আসছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক না গলাতে বললেও পাকিস্তান সেটা শোনেনি। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেমের মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রেক্ষিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অযাচিতভাবে বিবৃতি দেয়। এর আগেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল পাকিস্তান। এসব ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে প্রতিবাদ-পাল্টা প্রতিবাদ, কূটনীতিকদের তলব-পাল্টা তলব-বহিষ্কার পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। এদিকে সম্প্রতি ভারতশাসিত কাশ্মীরে সেনা ছাউনিতে জঙ্গী হামলার পর নয়াদিল্লী পাকিস্তানকে দায়ী করে। জাতিসংঘ অধিবেশনেও এ নিয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তেজনা ছড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ মঙ্গলবার ইসলামাবাদ সম্মেলন বয়কটের কথা জানিয়ে পাকিস্তানকে ইঙ্গিত করে বলেন, সন্ত্রাস ও সহযোগিতা একসঙ্গে চলতে পারে না। সার্ক জোটের অপর দুই সদস্য আফগানিস্তান ও ভুটানও একই পথে হাঁটায় আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে পাকিস্তান। সার্কের রীতি অনুযায়ী, জোটভুক্ত কোন একটি দেশও অংশ নিতে অপারগ হলে সম্মেলন হতে পারে না। পাকিস্তান বলছে, যদিও এ ব্যাপারে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি, তারপরও সম্মেলনে যোগ না দেয়ার ঘোষণা দুঃখজনক। এদিকে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের না যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। নয়াদিল্লীতে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উপমহাদেশের শান্তি, নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছিল। উপমহাদেশে যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সার্কের মতো শীর্ষ সম্মেলনের পরিস্থিতি নেই। এই অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিস্থিতিতে কোন আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সফল হবে না। এ ধরনের অনুষ্ঠান অর্থহীন হয়ে যাবে বলেই মনে করে বাংলাদেশ। হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ কিছু ঘটনায় আস্থার জায়গায় নেই। পাকিস্তান যেভাবে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, তাতে আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ একাধিকবার তার মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছে, পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করেছে। তবে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তান মনোভাব বদলায়নি। বাংলাদেশ অসন্তুষ্ট হয়েছে। সার্কের স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনেও বাংলাদেশ অংশ নেয়নি। এই নীরব প্রতিবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। তবে প্রতিবেশীদের বিষয়ে পাকিস্তানের মনোভাব বদলায়নি। সার্কের কাঠামো অনুযায়ী সদস্য দেশগুলোর যে কোন একটি রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত না হলেই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। এর আগে কার্গিল যুদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অরাজকতার জেরে ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত স্থগিত ছিল সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। ২০০৪ সালের পর এই প্রথম পাকিস্তান সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করছে। ২০১৪ সালের নবেম্বরে নেপালে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়। চলতি বছর ১৭-১৮ মার্চ নেপালের পোখারায় সার্ক দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত হয়। সে অনুযায়ী আগামী ৯-১০ নবেম্বর পাকিস্তানে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। পাকিস্তানের পরে ২০তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার সাত দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার ফোরাম সার্ক ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে। পরে আফগানিস্তান এই সংস্থার সদস্যপদ পায়। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার লক্ষ্যে সার্ক গঠন করা হয়। তারপর থেকেই সার্ক এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বর্তমানে সার্কের আটটি সদস্য দেশ ছাড়াও নয়টি পর্যবেক্ষক দেশ রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, মরিশাস ইত্যাদি। সার্কের পর্যবেক্ষক দেশগুলোও অব্যাহত সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
×