ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

ফিরে যাও আমেরিকা

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ফিরে যাও আমেরিকা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কট্টর সমালোচকরা প্রায়শই কৌতুকছলে বলে থাকেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার কোন শত্রুর প্রয়োজন নেই! উক্তিটি কৌতুকছলে বলা হলেও আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের যার বন্ধু তার কোন শত্রুর প্রয়োজন নেই! উক্তিটি কৌতুকছলে বলা হলেও আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির ভিত্তি বলে বিবেচিত আরেকটি বিখ্যাত উক্তি বিবেচনায় নেই, বিষয়টি আর কৌতুক থাকে না, উক্তিটি এমন, ‘বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কোন স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, যা আছে তা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি পরিচালিত হয় তার নিজস্ব স্বার্থকেন্দ্রিক এখানে বন্ধুত্ব যেমন বিবেচনাযোগ্য নয় তেমনি শত্রুতাও স্থায়ী নয়। বিগত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে মার্কিন সামরিক বাহিনী জাপানের ওকিনাওয়াতে ৪০ বর্গকি.মি. এলাকা জাপান সরকারের কাছে হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ৩০ হাজার সেনা অধ্যুষিত ওই দ্বীপে এটিই সর্ববৃহৎ ভূমি হস্তান্তরের ঘটনা। গত জুনে স্থানীয় এক মহিলাকে ধর্ষণ ও হত্যাকে কেন্দ্র করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় তারই ফলে এ সিদ্ধান্ত। গত জুলাই এ তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক ক্যুয়ের পর মার্কিন সামরিক স্থাপনার ও সেনা উপস্থিতির বিরোধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে সর্বোচ্চ মাত্রায়। তুর্কীরা অভিযোগ করছেন এনকারলিক বিমান ঘাঁটিস্থ মার্কিন সেনারা ওই চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। ঘটনার তিন দিন পর সরকারপন্থী সাংবাদিক ইউসুফ কাপলান তার টুইটার বার্তায় উল্লেখ করেন, ‘ইউএসএ তুমি কি জান তোমরাই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী! আমরা জানি সব ক্যুয়ের পেছনে রয়েছ তোমরা! আমরা বেকুব নই! ইউএসএ বাড়ি ফিরে যাও।’ বর্তমান বিশ্বে অন্য যে কোন দেশের তুলনায় ভিনদেশে মার্কিন স্থাপনার সংখ্যা বেশি : ৭০টি দেশে প্রায় ৮০০ স্থাপনা ছড়িয়ে আছে। বহির্বিশ্বে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সদস্য কর্মরত। এর মধ্যে জাপানে ৪৯ হাজার দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৪ হাজার এবং জার্মানিতে কর্মরত ৩৮ হাজার সেনা সদস্য যেখানে মার্কিন সরকারের সামরিক ব্যয় প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার। বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় বিদেশে মার্কিন স্থাপনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকির কথা বলা হতো। শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এ ঝুঁকি কমে এলেও অন্য কারণ উদ্ভব হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৯৯০ এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বাহরাইন কিংবা তুরস্কের মতো দেশগুলো সামরিক কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। (আইএসবিরোধী সামরিক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে ইনকারলিক থেকে।) সম্প্রতি চীনের বেড়ে ওঠা নৌশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে প্যাসিফিক অঞ্চলে তার উপস্থিতি সংহতকরণের কথা ভাবাচ্ছে। বিদেশে সামরিক স্থাপনার বিষয়ে মার্কিন নাগরিকরা তাদের সর্বোচ্চ সমর্থন ব্যক্ত করেন সেপ্টেম্বর ১১ হামলার পর; যখন ৪৮% মার্কিন নাগরিকের বিশ্বাস ছিল এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা মোকাবেলায় ভিনদেশে সৈন্য প্রেরণ একটি কার্যকর পন্থা হতে পারে। এখনও সমসংখ্যক আমেরিকান তা বিশ্বাস করেন। ৪৭% মার্কিন নাগরিকের ধারণা ভিনদেশে সৈন্য প্রেরণ কোন সমাধান নয়- এটি একদিকে যেমন ঘৃণার উদ্রেক করবে অন্যদিকে আরও সন্ত্রাসী হামলাকে উৎসাহিত করবে। জাপানের বিভিন্ন অংশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনার সংখ্যা ৮৫টি। গত জুনে ওকিনাওয়াতে ঘটে যাওয়া বিক্ষোভ ধারাবাহিকভাবে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিবিরোধী বিক্ষোভের কেবল একটি সর্ববৃহৎ বিক্ষোভটি ছিল ১৯৯৫ এ যখন ৮৫ হাজার ওকিনাওয়াবাসী রাস্তায় নেমে আসেন তিন আমেরিকান সৈন্য কর্তৃক ১২ বছরের এক বালিকাকে গণধর্ষণের প্রতিবাদ জানাতে। অতীতে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বে পশ্চিম জার্মানিতে মার্কিন স্থাপনার সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। অনেকের মতে, এ সংখ্যা প্রায় ৯০০। যে কারণে স্কুল, হাসপাতাল, স্পোর্টস কমপ্লেক্স। বিপণি বিতান পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীগণ তাদের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। এই বিক্ষোভ ’৮০-এর দশকের শেষ প্রান্তে এসে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় সঙ্গে যোগ হয় আণবিক অস্ত্রবিরোধী মনোভাব ও বামপন্থীরা। রেড আর্মি এবং বিভিন্ন বিপ্লবী সংস্থা সশস্ত্র আক্রমন পরিচালনা শুরু করে আমেরিকান স্থাপনা কেন্দ্র করে এবং সৈন্যদের অপহরণ করে। এ কথা সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন সামরিক স্থাপনা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর স্বার্থের অনুকূল বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ১৯৯৫ এ ওকিনাওয়াতে বিক্ষোভের পর আমেরিকা-জাপান কর্তৃপক্ষ যৌথ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা ফুতেনমার নৌ-বিমানঘাঁটি বন্ধ করে দিয়ে হেনেকো নামক জেলেপল্লীতে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করবে। পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়, স্থানীয় জনগণ পুনর্নির্বাচনে সামরিক স্থাপনাবিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেছে নেয় যাদের অন্যতম তাকেশি ওনাগা যিনি গত জুনের স্থানীয় নির্বাচনে ওকানাওয়ার গবর্নর নির্বাচিত হন। তার পরও শিনজো অ্যাবে জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পরিকল্পনাটি নিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্টা করছেন। তার এ চেষ্টার সুনির্দিষ্ট কারণও রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক সক্ষমতা, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী মনোভাব এর বিপরীতে জাপানের সামরিক শক্তির বৃদ্ধির বিকল্প নেই আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার কিন্তু ওকিনাওয়াবাসী স্থানীয় নির্বাচনে শিনজো অ্যাবেকে যে বার্তাটি দিয়েছেন তা পরিষ্কার অর্থাৎ মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কাম্য নয়। এ ছাড়াও ফিলিপিন্সের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীকে চলে যেতে হবে বলছেন নতুন রাষ্ট্রপতি দুতেতে। তুরস্কে মার্কিন সামরিক বাহিনীর শুরুটা সুখকর হলেও মধুচন্দ্রিমা শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৯৬০ এর শেষে এসে যা প্রতিধ্বনিত হয়। ইয়াঙ্কি বাড়ি ফিরে যাও এই সেøাগানে। এমনকি সেখানেও মার্কিন সেনা অপহরণের ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে তুরস্কের মাটিতে মার্কিন সেনা উপস্থিতি অনেকের কাছেই আর কাক্সিক্ষত নয়; ২০১১, ২০১৪ এবং এ বছরের এপ্রিলে তুরস্কের নাগরিকরা মার্কিন সেনাদের উপস্থিতিতে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে নানাভাবে। এমনকি ২০০৯ মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার তুরস্ক সফরের সময় ক্রোধে চিৎকার করেছে, ‘ফিরে যাও ইয়াঙ্কি’ এবং ‘বেরিয়ে যাও আমাদের দেশ ছেড়ে’ বলে। স্বঘোষিত বিশ্ব মোড়ল সেজে পুলিশী ভূমিকায় অবতীর্ণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বহির্বিশ্বে সৈন্য প্রেরণ নিয়ে খুব একটা সুখে নেই এ কথা বলাই যায়। যখন সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় অকৃতজ্ঞের মতো চিৎকার করছে- ‘ফিরে যাও আমেরিকা।’
×