ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

আজও কি তাসকিন ঝলক?

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আজও কি তাসকিন ঝলক?

আমি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরব, নিজেকে প্রমাণ করব- এমনটাই বলেছিলেন দারুণ জেদ আর আক্ষেপ নিয়ে। টি-২০ বিশ্বকাপের মাঝপথে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। দারুণ কিপটে বোলিং করে দলের নির্ভরযোগ্য পেসার হয়ে ওঠা পেসার তাসকিন আহমেদের জন্য কষ্টটা সহ্য করা বেশ কঠিনই ছিল। কারণ, দলকে সুপার টেনে উঠতে ভূমিকা রেখেও খেলতে পারেননি। বোলিং এ্যাকশনে ত্রুটির কারণে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হলেন। এ কারণেই ওমন জিদ নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। অবৈধ এ্যাকশন, তাই নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। তবু কেঁদেছিল বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ। এমনকি কিংবদন্তি অনেক বিদেশী ক্রিকেটারও ওই নিষেধাজ্ঞা মানতে পারেননি। ধাক্কাটা জোরেশোরে লেগেছিল উজ্জীবিত বাংলাদেশ দলে। মানসিকভাবে দারুণ মুষড়ে পড়েছিল টাইগাররা- এমনকি সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা আবেগে কেঁদে বলেছিলেন- আমাকে নিষিদ্ধ করা হোক, তাসকিন কেন? ওর তো ক্যারিয়ার অনেক পড়ে আছে। এতকিছুর পেছনে আসল কারণ ছিল- টুর্নামেন্টের মাঝপথে কখনও কোন দলের নির্ভরযোগ্য বোলারকে এভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি ত্রুটিমুক্ত এ্যাকশনের জন্য। তবে কোনকিছুতেই কাজ হয়নি। এ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তাই আরও বলেছিলেন,‘এই ঘটনা হয়ত আমাকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে, ঘটনাটা না ঘটলে অতটা দূরে আমি হয়ত যেতে পারতাম না। আমি আরও কঠিন হয়ে ফিরব।’ মাত্র ২১ বছর বয়সে এমন কঠোর মানসিকতা নিয়ে কথাগুলো বলা হয়ত সহজ- কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন। কিন্তু সেটাই করে দেখালেন। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার দুদিন পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে ৪ উইকেট শিকার করে আফগানিস্তানের প্রায় নিশ্চিত জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। ফেরার ম্যাচেই এমন নৈপুণ্য পুরো বিশ্ব ক্রিকেটকে বার্তা দিয়েছে তাসকিন আগের মতোই আছেন- অথবা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। বীরোচিত প্রত্যাবর্তনই ঘটেছে তরুণ এ গতি তারকার। নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিশ্বের সাবেক অনেক গতিতারকাই এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অনেকে। সত্যিকারের বীরেরা এভাবেই কিন্তু যে কোন খারাপ পরিস্থিতি থেকে ফেরে। ১৯ মার্চ যদি হয় অন্ধকার একটা দিন, তবে ২৩ সেপ্টেম্বর একটি আলোকিত দিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য। প্রথম তারিখটায় পেসার তাসকিন ও বাঁ-হাতি স্পিনার আরাফাত সানি ত্রুটিযুক্ত বোলিং এ্যাকশনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অবৈধ করেছিল এ্যাকশন পরীক্ষার পর। টি-২০ বিশ্বকাপের মাঝ সময়ে সেটা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট এবং ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের দেশ বাংলাদেশের জন্য মর্মন্তুদ ঘটনা। হতাশা আর ক্ষোভের অনলে পুড়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল সকলের মন। আর দ্বিতীয় তারিখটায় আইসিসিই তাসকিন-সানির বোলিং এ্যাকশনকে ত্রুটিমুক্ত ঘোষণা করে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইসিসি তাসকিন ও সানির বোলিং এ্যাকশন বৈধ ঘোষণা করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে কোন সময় ফিরতে আর কোন বাধা নেই এ দুই নির্ভরযোগ্য বোলারের। গত ৮ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন ন্যাশনাল ক্রিকেট সেন্টারের ল্যাবরেটরিতে বোলিং এ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের বৈধ প্রমাণিত করেন তারা। ভারতের মাটিতে মার্চে টি-২০ বিশ্বকাপ চলার সময় তাসকিন ও সানির বোলিং এ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। ৯ মার্চ ধর্মশালায় হল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ চলার সময় এ দুজনের বোলিং এ্যাকশনে ত্রুটি রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন দায়িত্বরত দুই আম্পায়ার। এরপর ১২ মার্চ সানি ও ১৫ মার্চ তাসকিন চেন্নাইয়ের শ্রী রামচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে নিজেদের বোলিং এ্যাকশনের পরীক্ষা দেন। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি দুজনই। অতীতে যাদের বোলিং এ্যাকশনের দুয়েকটি ডেলিভারিতে ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছিল সেসব ক্ষেত্রে ওই বোলারকে সেসব ডেলিভারি দেয়া থেকে বিরত করা হয়েছে, পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। সে কারণে এই নিষেধাজ্ঞা মানতে পারেনি বাংলাদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা এবং সাধারণ মানুষ। অনেকে এটিকে ক্রমোন্নতির দিকে থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্র বলেও মনে করেছিলেন। আইসিসির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন, মানববন্ধন, মিছিল, সমাবেশ হয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকেও এই সিদ্ধান্তের নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। আপীল করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা বাতিলের জন্য। বিশ্বের অনেক সাবেক ক্রিকেটার, পেসাররা তাসকিনের এ্যাকশনে ত্রুটি নেই বলেও দাবি করেছিলেন। তবে আইসিসি অনড় থেকে সিদ্ধান্ত আর পাল্টায়নি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন তারা। বোলিং কোচদের সঙ্গে নিজেদের বোলিং নিয়ে কাজ করা এবং পরীক্ষা দেয়ার পর ইতিবাচক ফল আসায় দুজনই ছিলেন আত্মবিশ্বাসী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার ব্যাপারে। দেশে অবৈধ বোলিং এ্যাকশন রিভিউ কমিটির কাছে দেয়া পরীক্ষায় তারা পাসও করেন। এরপর বিসিবি ‘টু-ডি’ প্রযুক্তিতে নিজেরাই পরীক্ষা করে দেখে দুই বোলারের এ্যাকশন। তাতে বিসিবির বিশেষজ্ঞরা সন্তুষ্ট হওয়ার পর দুজনকে পাঠানো হয় আবার এ্যাকশনের পরীক্ষা দেয়ার জন্য। অবশেষে গত ৮ সেপ্টেম্বর পুনরায় নিজেদের বোলিং এ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়েছিলেন দুজন। আত্মবিশ্বাসী ছিলেন দলের সাবেক বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক ও রুয়ান কালপাগে ছাড়াও প্রধান কোচ চান্দিকা হাতুরাসিংহে। বিসিবির কর্মকর্তারা এবং নির্বাচকরাও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তাসকিনের ব্যাপারে। এ কারণে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ঘোষিত ১৩ সদস্যের দলে তাসকিনের জন্য জায়গা উন্মুক্ত রেখেছিলেন নির্বাচকরা। এবার আর তার ফেরার সব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়। এর আগেও সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ্যাকশন শুধরে বোলিংয়ে ফিরেছিলেন বাংলাদেশের দুই স্পিনার আবদুর রাজ্জাক ও সোহাগ গাজী এবং পেসার আল-আমিন হোসেন। প্রতিক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছেন বোলাররা। এবার আফগানদের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচেই তাসকিন ফিরলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এভাবে দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ থাকার পর এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিরত থাকার পর স্বরূপে ফেরাটা খুবই কষ্টকর। এর আগে পারেননি পাকিস্তানের স্পিনার সাঈদ আজমল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুনিল নারাইন। তাসকিনও যেভাবে শুরু করেছিলেন মনে হচ্ছিল তিনিও হারিয়ে গেছেন। কারণ আফগান ব্যাটসম্যানরা তাকে তুলোধুনো করেছেন। বলে যে দারুণ নিয়ন্ত্রণ- সেটারও বিন্দুমাত্র লেশ পাওয়া যায়নি। ৬ ওভারেই ৪৯ রান দেন, সঙ্গে ছিল ৫টি ওয়াাইড। কোথায় সেই তাসকিন? যার বলে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব মারদাঙ্গা ব্যাটসম্যানরা রান করতেই হিমশিম খেয়ে যেতেন! তাসকিন ফুরিয়ে গেছেন। কিন্তু নাটকীয়তার তখনও বাকি। এমন বোলিং যিনি করেছেন তাকেই আবার বল দিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘আগের বাজে ওভারগুলোর কথা ভেবে বোলিং করলে এখান থেকে দলকে হারাতে পার। কিংবা ওসব ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে বল করে পার দলকে জেতাতে। বাকিটা তোমার ওপর।’ এই কথাটি দারুণ অনুপ্রাণিত করেছিল তাসকিনকে। স্বরূপে ফিরলেন ৪৮তম ওভারে, যখন আফগানরা জয়ের স্বপ্নে বিভোর। মাত্র ৬ রান দিলেন, কিন্তু তুলে নিলেন ২ উইকেট। শেষ ওভারে তাসকিন গতির সঙ্গে ছড়ালেন ত্রাস- তখন আফগানদের প্রয়োজন ১৩ রান! মাত্র ৫ রান দিয়ে আরও দুটি উইকেট শিকার করে আফগানদের ইনিংস মুড়িয়ে দিলেন তাসকিন- জেতালেন বাংলাদেশকে। শেষ পর্যন্ত ৮ ওভারে ৫৯ রান দিয়ে তিনি নেন ৪ উইকেট। শেষের দুই ওভারে ১০ রান দিয়ে ৪ উইকেট। ভয়ঙ্করতম পেসারদের এর চেয়ে বড় নমুনা আর কি হতে পারে? পরাজয়কে যে গৌরবময় জয়ে পরিণত করতে পারে সেই তো সত্যিকারের বীর! সেই বীরোচিত ঘটনার জন্ম দিলেন তাসকিন। এ বিষয়ে বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশও উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘আমরা তাকে একটি বার্তা দিয়েছি যেন তিনি কিছুটা স্বস্তিতে থাকার চেষ্টা করেন এবং মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি প্র্যাকটিসে আমরা কি করেছি। যতটা পারা গেছে সবাই চেষ্টা করেছে ফিট থাকার। আমি মনে করি সে অনেক ভাল করেছে। খেলার আগে সে কিছুটা চাপে ছিল। সে আইসিসি কর্তৃক রিপোর্টেড ছিল। তাই দীর্ঘ দশ মাস না খেলে এ ধরনের ম্যাচে ফেরা চাপের। আমার মনে হয় সে শুরুতে কিছুটা কঠিন হয়ে ওঠার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু আমাদের যেমন প্রয়োজন ছিল শেষ পর্যন্ত সেটাই সে দিতে পেরেছে।’ তবে শেষটা এমন সাফল্যম-িত না হলে ক্যারিয়ারটাই হুমকির মুখে পড়ত তাসকিনের। এ বিষয়ে ওয়ালশ বলেন, ‘সে যেভাবে ফিরেছে সেটার কৃতিত্ব তাঁকে দিতেই হবে। সার্বিকভাবে তার একটি খারাপ দিন হতে পারত এবং সেটা আমাদের এই ম্যাচ হাতছাড়া করে দিত।’
×