ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তির আলোয় আশরাফুলের ফেরা;###;তোফায়েল আহমেদ

বেঁচে থাকলে জাতীয় দলে ফিরবই

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বেঁচে থাকলে জাতীয় দলে ফিরবই

২৫ সেপ্টেম্বর দিনটি কি আলাদা করে লেখা থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের মনে? থাকার উপলক্ষ আছে বেশ কয়েকটি। হোম অব ক্রিকেটখ্যাত মিরপুরে এদিন প্রায় ছয় মাস বিরতির পর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছে টাইগাররা। টি-২০ বিশ^কাপে অবৈধ বোলিং এ্যাকশনের অভিযোগে নিষিদ্ধ হওয়া তাসকিন আহমেদও এ ম্যাচ থেকেই আবার ফিরে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলার স্বাধীনতা। বাংলাদেশও যে ৭ রানে হারাল আসগার স্টানিকজাইদের, উত্তেজনার বারুদে ঠাসা এই ম্যাচটিকেই বা ভোলা যায় কি করে! এত কিছুর মাঝে আরও একটা ব্যাপার ঘটে গেছে সাধারণের অলক্ষ্যে। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরেছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে এনসিএলে ঢাকা বিভাগের বিপক্ষে ঢাকা মেট্রোর হয়ে মাঠে নেমেছেন এক সময়ের ওয়ান্ডারবয়। ওয়ান্ডারবয়! ওয়ান্ডারবয়!! উপমাটি ব্যবহার করতে কি এখন দ্বিধা লাগে আপনার? লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। এ দেশের ক্রিকেট আবেগের মঙ্গে মিশে থাকা একটি নাম যখন ফিক্সিংয়ের মতো চোরাবালিতে জড়িয়ে ফেলল নিজেকে, তখন থেকেই তো তার নামের সঙ্গে এই উপমাগুলো নিষ্ঠুতার হাসি হাসে। সাড়ে তিন বছর আগের সেই দিনটি আজ হয়ত কেউ ভুলতে পেরেছেন, কেউ পারেননি। তাই বলে একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ, যিনি ভুল করে ঢুকে পড়েছেন নিষিদ্ধ কোন সুড়ঙ্গে, তাঁর কি ফেরার পথ থাকবে না? মোহাম্মদ আশরাফুল ফেরার পথেই হাঁটছেন সাড়ে তিন বছর ধরে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে, সব স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়ে ভেঙ্গে পড়েছিলেন কান্নায়। এরপর ২০১৩ সালের আগস্টে নিষিদ্ধ হওয়ার দিন থেকে পরিশুদ্ধতার পথে হেঁটেছেন। গেল ১৩ আগস্ট পেয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার স্বাধীনতা। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অধিকার পাবেন আরও দুই বছর পর। ক্রিকেটই যার জীবন, সেই আশরাফুল ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরতে পেরেই এখন নতুন করে তাকাচ্ছেন সামনে। বাংলাদেশের ক্রিকেট হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে আজ দূরের পথের যাত্রী। বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে নব্য এক শক্তিই বলা হয় লাল-সবুজের দেশকে। ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদাপ্রাপ্তির পর যে ক্রিকেটারদের হাত ধরে এই বড় শক্তি হয়ে ওঠা, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আশরাফুল নামটি এখনও উপরের দিকেই থাকে। না থাকার উপায়ই বা কি? কার্ডিফ, গায়ানা, কলম্বো...। কত সব গল্পের রচয়িতা ছোটখাটো গড়নের এই মানুষটি। যে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে ২৫ সেপ্টেম্বর শুরু করলেন ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়, সেখানেও তো ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কাকে প্রথম বারের মতো হারানোর অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি। সেই আশরাফুল মুক্তির আলোয় ফিরার পর জনকণ্ঠকে দেয়া সাক্ষাতকারে খুলে দিলেন মনের দুয়ার। পাওয়া গেলে বুক থেকে পাথর নেমে যাওয়া পৃথিবীর সুখী এক মানুষকে, ‘ক্রিকেটহীন সাড়ে তিনটা বছর যে কত যন্ত্রণায় কাটিয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। তেরো-চৌদ্দ বছর নিয়মিত যে টিমমেটদের সঙ্গে খেলেছি, তাদের এখন নতুন করে ফিরে পেয়েছি। সকালে উঠে সবার সঙ্গে ব্রেকফ্রাস্ট করা, ওয়ার্মআপ করা, টিম প্র্যাকটিস, ড্রেসিংরুমে সময় কাটানোÑ এসব কিছুই মিস করতাম খুব। আবার সব আগের মতো ফিরে পেয়ে ভাল লাগছে। এ অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশের নয়।’ জীবনের পথে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াটা খুব সহজ। কিন্তু ফিরে আসাটা? যিনি এই পথ পাড়ি দেন কেবল তিনিই সেটা ভাল জানেন। ক্রিকেটে যেমন জানেন মোহাম্মদ আমিররা। আশরাফুলের মতো একই পথের পথিক যখন পুনরায় ফিরলেন ক্রিকেটে, সতীর্থদের কেউ তো সরাসরিই বলেছেন, বিশ^াসঘাতকের সঙ্গে ক্রিকেট নয়। তা মোহাম্মদ আশরাফুলকে কিভাবে গ্রহণ করল সতীর্থরা? ‘টিমমেটরা সবাই আমাকে পছন্দ করে। এতদিন খেলায় ছিলাম না, ওরাও আমাকে মিস করত। এখন ফিরে পেয়ে খুশি ওরাও। সবাই খুব সাপোর্ট করছে আমাকে।’ - বলেন আশরাফুল। ওয়ালটন জাতীয় ক্রিকেট লীগ শুরুর দিন থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বগুড়ায় ঢাকা মেট্রো-ঢাকা বিভাগের ম্যাচটি প্রথম দুই দিনে হতে পেরেছে সাকল্যে ১৫ ওভার। টস জিতে ব্যাটিং নেয়া মোহাম্মদ আশরাফুলদের ঢাকা মেট্রো প্রথম দিন ২ উইকেটে ৪৭ করার পর দ্বিতীয় দিন ব্যাটিংই করতে পারেনি পুরো দিন বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায়। মোহাম্মদ আশরাফুলের ব্যাট হাতে নামাটা তাই বিলম্বিত হয়েছে। বৃষ্টির কবলে পড়া বগুড়া ম্যাচের সব কিছু এখন প্রকৃতির হাতেই। তবে আশরাফুল তাকাচ্ছেন সামনে, ‘বৃষ্টির কারণে তো প্রথম দুদিন ব্যাটিংয়ে নামাই হয়নি। এখন দুদিন বাকি (মঙ্গল এবং বুধবার)। নামলে ভাল করারই লক্ষ্য।’ এই যে ফিরে আসা, তার পেছনে সাধারণ দর্শকদের ভালবাসাটাও পাশে পেয়েছেন আশরাফুল। দর্শকদের প্রতি তাই আলাদা কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়কের, ‘দর্শকরা সারা জীবনই আমাকে সাপোর্ট দিয়ে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে। বিশেষ করে এই সাড়ে তিনটা বছর তারাই ছিল আমার বড় অনুপ্রেরণ। তদের জন্য তাই অনেক বড় একটা যায়গা রয়েছে আমার বুকে।’ এ কারণেই বোধহয় আবার দর্শকদের দারুণ সব ইনিংস উপহার দিতে চান আশরাফুল, ‘ঢাকা লিগ, জাতীয় লীগ, বিসিএলে খেলব এখন। এসব জায়গায় ভাল ভাল ইনিংস উপহার দিতে চাই দর্শকদের।’ ১৯৯৩ সালে অমর জ্যোতি ক্লাবে যেদিন নয় বছরের আশরাফুলকে খুঁজে পেয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজনরা, সেদিন থেকেই তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু। দিনে দিনে যা কেবলই বড় হয়েছে। আশাবাদী মানুষের সংখ্যায়ও বেড়েছে। এক সময় তো পুরো জাতির প্রত্যাশার ভারই এসে পড়ে তাঁর একার কাঁধে। আশরাফুল প্রত্যাশার প্রতিদান অনেকই দিয়েছেন। আবার ব্যর্থও হয়েছেন। সেই ব্যর্থতাগুলোর মার্জনার জায়গা ছিল বটে। কিন্তু ২০১৩ সালের বিপিএল কা-ে কি মার্জনা পাওয়া যায় অত সহজে! আশরাফুল মার্জনা চান। আবারও পুরো জাতির প্রত্যাশার ভার বইতে চান। প্রতিদান দিতে চান কার্ডিফ-গায়ানার মতো করে, ‘যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন ক্রিকেট, এই দেশ, দেশের মানুষ থাকবে আমার হৃদয়ে। ক্রিকেটে ফিরে এসেছি। এখন আবার ভাল কিছু করতে চাই। ভাল ভাল ইনিংস উপহার দিতে চাই।’ তবে আপাতত জাতীয় দল নিয়ে কোন ভাবনা নয়। বাস্তবতার জমিতে পা রেখে আশরাফুল ভাবতে চান শুধুই ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে, ‘জাতীয় দল নিয়ে চিন্তা করলে তো আর সেটা এখনই পাব না। এমন যদি হতো, এখানে এক দেড়-হাজার রান করলে আমাকে জাতীয় দলে ফেরানো হবে, তাহলে হয়ত সেই চিন্তা করা যেত। কিন্তু প্রেক্ষাপটটা তো তেমন নয়। সেটা এখনও অনেক দেরি। দুই বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলব। তারপর...। এই মুহূর্তে তাই শুধুই ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়েই ভাবছি।’ আশরাফুলের এই নতুন জীবনের শুরু যে শুধই আনন্দময় পরিবেশে হয়েছে তা বলা যাবে না। নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির পর ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম ম্যাচ। অথচ এর ঠিক পাঁচ দিন আগেই হারিয়েছেন বাবাকে। ৫ সেপ্টেম্বর নিজে বাবা হওয়া, ২০ সেপ্টেম্বর আবার বাবা হারানো। আশফুলের বুকজুড়ে কি ঝড়ই না বয়ে গেছে। তার পরও আশরাফুল সব কিছুকে জীবন বলেই মেনে নিয়েছেন। ‘আমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গর্বিত ছিলেন আমার বাবা। আসলে এই সময়ে বাবাকে অনেক মিস করছি। বাবা সাবে চেয়ারম্যান ছিলেন। তার আলাদা পরিচয় ছিল। গ্রামে তার নিজেরই অনেক জনপ্রিয়তা। তার পরও বাবা নিজেকে আশরাফুলের বাবা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্বিত ছিলেন। তার কছে যখন যেভাবে যা চেয়েছি তিনি আমাকে সবই দিয়েছেন। কখনও কোন আবদার অপূর্ণ রাখেননি। বাবাকে আসলে মিস করব সারা জীবনই। তার পরও জন্ম-মৃত্যু এসব নিয়েই তো সামনে চলতে হয়। এখানে মানুষের তো কোন হাত নেই...’ বললে বললে ধরে আসে আশরাফুলের গলা। দুঃসময় ফেলে এসে নতুন করে সব শুরুর জন্য দর্শকদের কথা আলাদা করেই বলেছেন আশরাফুল। বললেন নিজের পরিবাবের কথাও, ‘মা-বাবা, বোন, ভাই-ভাবি সবাই ছিলেন পাশে। স্ত্রীর অবদানও কম নয়। তাদের সবার সহযোগিতায় এখন সব কিছু নতুন করে ভাবতে পারছি।’ আশরাফুলের নতুন করে এই ভাবনাটা আপাতত ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়েই। তবে দূরের পথের কথা বললে সেটি জাতীয় দলই। কিন্তু এমন যদি হয় জাতীয় দলে এখন এত তারকার ভিড়ে কোন কারণে ফেরা হলো না তার? বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক প্রশ্নটা উড়িয়ে দিলেন যেন পুল শর্টের মতো করে, ‘যদি বেঁচে থাকি এবং সুস্থ থাকি তাহলে এ রকম হবে না আশা করি। জাতীয় দলে খেলবই ইন্শা আল্লাহ্।’ বাংলাদেশের সব ক্রিকেটপ্রেমীর চাওয়াটাও আসলে এমনই।
×