ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হিযবুত সমন্বয়ক মহিউদ্দিনসহ ৬ জনের বিচার শুরু

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

 হিযবুত সমন্বয়ক মহিউদ্দিনসহ ৬ জনের বিচার শুরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রধান সমন্বয়ক ও বাংলাদেশে আধুনিক জঙ্গীবাদের ধারা চালুকারীদের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমদসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় চার্জগঠন করেছে ঢাকার সিএএম আদালত। এই শিক্ষক বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে রয়েছেন। তবে তার চাকরি আছে। মামলার রায় অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোঃ কামরুল হোসেন মোল্লা মঙ্গলবার শুনানি শেষে চার্জগঠনের আদেশ দেন। এরমধ্য দিয়েই ২০১০ সালে রাজধানীর উত্তরা থানায় দায়ের করা সস্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়েরকৃত মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। আসামিগণ অভিযোগ অস্বীকার করায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ২৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেন বিচারক। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল মহিউদ্দিনকে শেরেবাংলা নগর থানার গ্রীন রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে বিভিন্ন মামলায় রিমান্ডে নেয়া হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। ২০১০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই বাসায়ই গৃহবন্দী ছিলেন তিনি। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের মাধ্যমে যারা আধুনিক জঙ্গীবাদের যে ধারা চালু করেছেন, তাদেরই অন্যতম অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমেদ। সারাবিশ্বে জঙ্গীবাদের জন্য আলোচনায় থাকা পাকিস্তানেও সংগঠনটি ২০০৮ সালে নিষিদ্ধ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫৩টি দেশে জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। ২০০২ সালে ডেনমার্কে ইহুদী দেখামাত্র হত্যার ঘোষণা, ২০০৩ সালে তেলআবিবে এক মদের দোকানে বোমা হামলা চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা, ২০০৪ সালে উজবেকিস্তানের মার্কিন ও ইসরাইলী দূতাবাসে আত্মঘাতী বোমা হামলা, ২০০৪ সালে তাজিকিস্তানের তাসখন্দ এলাকায় বোমা হামলা করে ৪৭ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। সংগঠনটির বিরুদ্ধে আল কায়দা, তালেবান ও বৈশ্বিক জিহাদের জন্য কর্মী সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। সূত্র বলছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনটির গোড়াপত্তন হয়। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে সংগঠনটি জঙ্গীবাদে জড়িত বলে বার বার বলা হয়েছে। কিন্তু তা আমলে নেয়নি তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগায় জঙ্গী সংগঠনটির মাস্টারমাইন্ডরা। এক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের যোগসূত্র থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। বর্তমানে এই শিক্ষক জামিনে থেকে কর্মস্থলে বহাল রয়েছেন। ২০০২ সালে অধ্যাপক গোলাম মাওলার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ জঙ্গী সংগঠনটিতে জড়িত হন। এই দুই শিক্ষক, সমমনা ছাত্র ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শেখ তৌফিকের তৎপরতায় সংগঠনটির ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র, কাজী মোরশেদুল হককে যুগ্ম সমন্বয়কারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলাকে সিনিয়র উপদেষ্টা, বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. শেখ তৌফিককে রাজনৈতিক উপদেষ্টা, প্রিন্সিপাল মাওলানা মামুনুর রশীদকে গণসংযোগ সচিব, অধ্যাপক মুস্তফা মিনহাজকে মিডিয়া ও প্রচার সচিব, সাখাওয়াত হোসেন, মামুনুর রশীদ আনসারী, আহাম্মদ জামান, ডাঃ সাঈদ, মনির হোসেন, ডাঃ গোলাম মোস্তফা ও শাহজালাল মিয়াকে কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে রাখা হয়। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোল টেবিল বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে দলটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সংগঠনটি দেশী-বিদেশী এনজিও, উগ্র মৌলবাদী সংগঠন ও আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলে। কার্যক্রম শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ দেশের সব সরকারী-বেসরকারী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সংগঠনটির মহিলা শাখাও ছিল। জঙ্গী সংগঠনটির টার্গেট ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। এমন টার্গেটে পড়েই সংগঠনটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পরবর্তীতে গ্রেফতার হয় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খানের ছেলে রিসাদ কামাল খান, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যায় জড়িত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় ছাত্র, বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা ও ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপ হত্যাকারী বুয়েট ছাত্র মেজবাহ উদ্দিনসহ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বহু শিক্ষার্থী। ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার দায়ে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই, উগ্র ভাষায় লেখা লিফলেট, ট্রেনিং বেল্ট, বিভিন্ন দেশের জঙ্গী প্রশিক্ষণের ভিডিও ফুটেজসহ ৪০ প্রকারের আলামত উদ্ধার হয়। অভিযানে গ্রেফতার হয় অধ্যাপক গোলাম মাওলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ। পরবর্তীতে তারা জামিনে মুক্তি পান। গোলাম মাওলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে বহাল রয়েছেন। আর মহিউদ্দিন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে রয়েছেন। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, অধ্যাপক গোলাম মাওলা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। জামিনে থেকেই তিনি শিক্ষকতা পেশায় বহাল রয়েছেন। হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ অপর নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ বাধ্যতামূলক অবসরে রয়েছেন। তবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। চলমান মামলার রায় অনুযায়ী দুই শিক্ষকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি রয়েছে।
×