ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

কলকাতায় গ্রেফতার তিন জেএমবির একজন জামাই ফারুক

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কলকাতায় গ্রেফতার তিন জেএমবির একজন জামাই ফারুক

শংকর কুমার দে ॥ ভারতের কলকাতায় জেএমবির যে ছয় সদস্য ধরা পড়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ ভ্যান থেকে জেএমবির সদস্যদের ছিনিয়ে নেয়ার হোতা জেএমবির আনোয়ার হোসেন ওরফে ফারুক ওরফে জামাই ফারুকসহ তিন জেএমবি রয়েছে এবং প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তিন জেএমবি সদস্যকে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পুলিশ ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়া অপর দুই জেএমবির সদস্য সানি ও মিজানকে খুঁজছে বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা। বাংলাদেশের তিন জনসহ জেএমবির গ্রেফতারকৃত ছয় সদস্যকে সোমবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে হাজির করা হলে বিচারক সত্যার্ণব ঘোষাল তাদের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত এসটিএফ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীরা নিউ জেএমবি (নব্য জেএমবি) ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বলে মনে করেন কলকাতা পুলিশের এসটিএফ। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ইদগাহে জঙ্গী হামলার ঘটনাতেও জামাই ফারুকসহ তিন জেএমবির সদস্যকে খুঁজছে বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। কলকাতায় ধৃত আনোয়ার ওরফে জামাই ফারুকসহ জঙ্গীদের এই দলটির কয়েকজন সদস্য গুলশানের ঘটনার পর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জেএমবির শূরা সদস্য রাকিবুল হাসান ও সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) এবং বোমা বিশেষজ্ঞ মিজানকে (৩৫) ছিনিয়ে নেয় জেএমবির সদস্যরা। কাশিমপুর কারাগার থেকে পুলিশ ভ্যানের প্রহরায় জেএমবির সদস্যদের ময়মনসিংহ আদালতে হাজির করতে নেয়ার সময়ে ত্রিশালে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা ও কয়েকজনকে আহত করে তিন জেএমবি সদস্যকে ছিনিয়ে নেয়। এই জঙ্গী হামলার নেতৃত্ব দেয়া আনোয়ার হোসেন ওরফে জামাই ফারুক যিনি কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। জেএমবি তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর পথে ওইদিনই মির্জাপুরে রাকিবুল হাসান নামের এক জেএমবি জঙ্গী গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। বাকি দুজনের কোন খোঁজ না পেয়ে বাংলাদেশের পুলিশ তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ছিনিয়ে নেয়ার পর গত সাড়ে তিন বছরেও জেএমবির জঙ্গী সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) এবং বোমা বিশেষজ্ঞ মিজান ওরফে বোমা মিজানকে গ্রেফতার করা সম্ভবপর হয়নি। বাংলাদেশের পুলিশ তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জেএমবির নাম আসার পর তদন্ত করতে ঢাকায় আসে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ- এর একটি প্রতিনিধি দল। সে সময় বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে সন্দেহভাজনদের নামের একটি তালিকা দেয়া হয়। এর মধ্যে সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) এবং বোমা বিশেষজ্ঞ মিজান ওরফে বোমা মিজানের নামও আসে। সে সময় গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, জেএমবির একটি অংশের নেতা মাওলানা সাঈদুর রহমান কারাগারে থাকায় ওই অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ‘জামাই ফারুক’। তিনিই ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাইয়ের মূল পরিকল্পনায় ছিলেন বলে পুলিশের সন্দেহের কথাও বলা হয় সে সময়। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পর ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে তিন জেএমবির সদস্য ছিনিয়ে নেয়ার হোতা জামাই ফারুক ধরা পড়ে কলকাতায়। কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্রেফতার ছয় জঙ্গী পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে জেএমবির সিøপার সেল চালাচ্ছিল। তারা সেখানে হামলার পরিকল্পনা করছিল বলেও তদন্তকারীদের ধারণা। গত শনি ও রবিবার পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে ফারুকসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে, যাদের মধ্যে চারজন ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় অভিযোগপত্রভুক্ত (চার্জশিটভুক্ত) আসামি। কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে ইনাম জেএমবির পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বনগাঁওয়ের বাগদা রোড থেকে রোববার তাকে আটক করে পুলিশ। গ্রেফতার করা ছয়জনের কাছ থেকে বিস্ফোরক, ডেটোনেটর, জাল পরিচয়পত্র, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এবং বাংলাদেশী ও ভারতীয় মুদ্রা পাওয়া গেছে বলেও জানান কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেন ॥ দুর্গাপূজার নিরাপত্তা সম্পর্কিত এক বৈঠক শেষে মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার জেএমবি সদস্য আনোয়ার হোসেন ফারুকই ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে আসামি ছিনতাইয়ের ‘হোতা’ ফারুক হোসেন ওরফে জামাই ফারুক। ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়া পলাতক জেএমবির সদস্য সানি, মিজান, ফারুককে খোঁজা হচ্ছিল। ভারতে দুদিন আগে গ্রেফতার ছয় জঙ্গীর মধ্যে আর কেউ বাংলাদেশী থেকে থাকলে আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাদের ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানান তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই ফারুক আমাদের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার যে ঘটনা ঘটেছিল তার হোতা ছিল ফারুক। তার বিরুদ্ধে চার্জশিটও হয়েছে। তিনি বলেন, যতটুকু জেনেছি, সেই (ফারুক) ধরা পড়েছে। তবে অফিসিয়ালি এখনও আমাদের কেউ কিছু জানায়নি। অফিসিয়ালি জানতে আরও সময় লাগবে। ভারতে গ্রেফতার হওয়া ছয়জনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশী বলে কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা জানার চেষ্টা করছি। তারা বাংলাদেশী হলে আমাদের সঙ্গে ভারতের চুক্তি আছে, তার মাধ্যমে আমরা তাদের নিয়ে আসব। পূজায় নাশকতার ছক ॥ কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) বলেছে, ছয় জেএমবির জঙ্গী গ্রেফতার হওয়াতে পূজার মুখে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং উত্তরবঙ্গে জঙ্গী নাশকতার ছক ভেস্তে গেল। গত শনিবার রাতে অসমের শিলচরের শিলংপট্টি থেকে জালনোটসহ গ্রেফতার করা হয় জাহিদুল শেখ ওরফে জাবিরুল ওরফে জাহিদ নামে এক বাংলাদেশীকে। সে জুম জঙ্গী। তাকে জেরা করেই জঙ্গী মডিউলের বাকিদের সন্ধান মেলে। এরপর উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের নতুনবাজার থেকে মঙ্গলকোটের ইউসুফ এবং অসমের বরপেটার তারাবাড়ি থানার রোমারি পাথর গ্রামের বাসিন্দা শাহিদুল ইসলাম ওরফে সূর্য, বনগাঁর বাগদা রোড এলাকা থেকে বাংলাদেশের জামালপুরের দুই বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন ফারুক ওরফে কালো ভাই ও মহম্মদ রফিক ওরফে রুবেল এবং উত্তরবঙ্গের কোচবিহার থেকে গ্রেফতার করা হয় মঙ্গলকোটেরই কুলসোনা দীঘির বাসিন্দা আবুল কালাম ওরফে আজাদকে। হোয়াটস এ্যাপে যোগাযোগ করত জঙ্গীরা ॥ গায়েন্দা সূত্রের খবর, জঙ্গীরা হোয়াটস এ্যাপে যোগাযোগ রাখত। প্রযুক্তিগত কৌশলের সাহায্যে সেই সব কথা গোয়েন্দাদের হাতে আসে। তাতেই বাজিমাত হয়। বর্ধমান খাগড়াগড়ের পরে অধিকাংশ সময়ে অসম সীমান্ত দিয়ে জঙ্গীরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকত। অসমে বন্যা হওয়ায় তারা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ব্যবহার করছিল। গত সপ্তাহে অসমের কাছাড় থেকে জাল নোটের একটি মামলায় প্রথমে ধরা হয় বাংলাদেশের জেএমবির সদস্য জবিরুলকে। তাকে কলকাতায় এনে জেরার পরে বাকিদের হদিস মেলে। রবিবার নিউ কোচবিহার স্টেশনে গ্রেফতার করা হয় কালামকে। ওই দিনই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বনগাঁ-বাগদা রোড থেকে গ্রেফতার করা হয় ইনাম ও রফিককে। ইনাম ও রফিকের বাড়ি বাংলাদেশে। রফিক বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। আর জঙ্গীদের সীমান্ত পার করানো, লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা, এ সব করত রফিক। গ্রেফতারকৃতরা ৬ অক্টোবর পর্যন্ত হেফাজতে ॥ তিন বাংলাদেশীসহ ভারতে গ্রেফতার হওয়া ছয় জেএমবির জঙ্গীকে সোমবার হাজির করা হয় ব্যাঙ্কশাল আদালতে। বিচারক সত্যার্ণব ঘোষাল তাদের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত এসটিএফ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ধৃত জঙ্গীরা ইদানীং নিউ জেএমবির ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বলে জানান গোয়েন্দারা।
×