স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ স ম হান্নান শাহ আর নেই। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে পাঁটায় সিঙ্গাপুরের র্যাফেলস হার্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। আজ বুধবার সন্ধ্যায় হান্নান শাহর মরদেহ দেশে আনা হচ্ছে এবং শুক্রবার গাজীপুরের কাপাসিয়ার নিজ গ্রামে দাফন করা হবে। এদিকে হান্নান শাহর মৃত্যুতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন। দলের এ নেতার মৃত্যুতে ৪ দিনের শোক কর্মসূচী ঘোষণা করেছে বিএনপি।
হান্নান শাহ স্ত্রী নাহিদ হান্নান, মেয়ে শারমিন হান্নান সুমি এবং দুই ছেলে শাহ রেজাউল হান্নান ও শাহ রিয়াজুল হান্নানসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বড় ছেলে রেজাউল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বুধবার সন্ধ্যায় তার বাবার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় মহাখালী ডিওএইচএসের বাসার কাছের মসজিদে, বেলা সাড়ে এগারোটায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এবং জোহরের নামাজের পর নয়া পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ওই দিন হান্নান শাহর মরদেহ সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হবে। শুক্রবার সকালে তার লাশ সড়কপথে গাজীপুর নিয়ে যাওয়া হবে। সকাল নয়টায় জয়দেবপুর রাজবাড়ী মাঠে, সাড়ে দশটায় কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবং জুমার নামাজের পর নিজ গ্রাম চালাবাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।
৬ সেপ্টেম্বর মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় হান্নান শাহ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। তার সঙ্গে ছোট ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান ও ছোট মেয়ে শারমিন হান্নানও সিঙ্গাপুর যান। ১৩ সেপ্টেম্বর সেখানে র্যাফেলস হার্ট সেন্টারে ডাঃ এ্যালভিন এনজির নেতৃত্বে চিকিৎসকরা তার হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার (এনজিওপ্লাস্টি) করেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হান্নান শাহর হৃদযন্ত্রে চারটি রিং বসানো হয়। পরে অবস্থার উন্নতি হওয়ায় খুলে দেয়া হয় লাইফ সাপোর্টও। অস্ত্রোপচারের ১৩ দিনের মাথায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন হান্নান শাহ। তার ছোট ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান টেলিফোনে এ খবর বাংলাদেশে পৌঁছালে পরিবারের সদস্য ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
হান্নান শাহর মৃত্যুর খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকালে মহাখালী ডিওএইচএসে তার বাসায় যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি তার বড় ছেলে শাহ রেজাউল হান্নানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সমবেদনা জানান। পরে খালেদা জিয়াও ফোনে হান্নান শাহর পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান।
১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঘাগটিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হান্নান শাহ। তার বাবা ফকির আবদুল মান্নান ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। হান্নান শাহর ছোট ভাই শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ছিলেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি।
বিএনপি কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়, ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া হান্নান শাহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য বাঙালী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্র্কিট হাউসে একদল সেনা সদস্যের হাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাঙ্গুনিয়া থেকে তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ স ম হান্নান শাহ। এইচএম এরশাদ সরকারের সময় তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।
সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পেয়েছিলেন হান্নান শাহ। ১৯৮৩ সালে ওই পদ ছেড়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। শুরুতে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) ও ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দলের এ পদেই ছিলেন।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর-৪ আসন (কাপাসিয়া) থেকে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত পান। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও তিনি কাপাসিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় গেলেও সেবার হেরে যান হান্নান শাহ।
২০০৭ সালের শুরুতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দুই বছরের জরুরী অবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়া যখন কারাগারে, সে সময় বিএনপিকে সংগঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হান্নান শাহ। দলের সংস্কারপন্থী অংশের বিরুদ্ধে সে সময় গণমাধ্যমেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। দলের অন্য নেতারা যখন আত্মরক্ষার্থে নিজেদের আড়াল করে রাখতেন তখন প্রতিদিন নিজের মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বিএনপি ও খালেদা জিয়ার পক্ষে বক্তব্য রাখতেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি ও তার ছেলে কিছুদিন কারাবরণও করেন। এর আগে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছিল আ স ম হান্নান শাহকে। বর্তমান সরকারের সময়ও তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৩০টির বেশি মামলা রয়েছে।
হান্নান শাহর মৃত্যুতে বিএনপির ৪ দিনের শোক কর্মসূচী ॥ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ স ম হান্নান শাহর মৃত্যুতে চার দিনের শোক কর্মসূচী ঘোষণা করেছে বিএনপি। একই সঙ্গে খোলা হয়েছে শোক বই। মঙ্গলবার বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করবে। এ ৪ দিনই রাজধানীর নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। শুক্রবার সারা দেশে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল করা হবে। আর মঙ্গলবার সকাল থেকেই নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শোক বই খোলা হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এ বই খোলা থাকবে।
সিঙ্গাপুরে হান্নান শাহর প্রথম জানাজা ॥ হান্নান শাহর প্রথম জানাজা মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বাদ এশা সিঙ্গাপুরের ছেরাঙ্গন রোডের অ্যাঙ্গলিয়া জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। সিঙ্গাপুর বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাদেরের বরাত দিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেসউইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার এ তথ্য জানান।
হান্নান শাহর মৃত্যুতে খালেদা জিয়ার শোক ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ স ম হান্নান শাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন স্বাক্ষরিত এক শোক বার্তায় খালেদা জিয়া বলেন, হান্নান শাহর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকার্ত ও বেদনাহত। জিয়াউর রহমান এবং আমার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহকর্মী ও সহযোদ্ধা আ স ম হান্নান শাহর ইন্তেকালের দুঃসংবাদ আমার কাছে অকল্পনীয় ও বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো।
খালেদা জিয়া বলেন, আমি যখন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলাম তিনি দ্রত সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন তখন তার মৃত্যু সংবাদ এলো। এটা যে কত বড় দুঃসংবাদ তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। খালেদা জিয়া বলেন, দেশবাসী, ২০ দল ও বিএনপি পরিবারের সকলের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ তারা যেন মরহুমের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন শরিক দলের শীর্ষ নেতারাও হান্নান শাহর মৃত্যুতে অনুরূপ শোক প্রকাশ করেছেন।
বি চৌধুরীর শোক ॥ হান্নান শাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিকল্প ধারার সভাপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি চৌধুরী)। প্রেস সচিব জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এক শোকবাণীতে বি চৌধুরী বলেন, হান্নান শাহ সৎ ও সাহসী রাজনীতিবিদ ছিলেন। আমার সঙ্গে তার পরিবারের এবং হান্নান শাহের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে তার জন্মদিন এবং আমার জন্মদিন ১১ অক্টোবর। আমি হান্নান শাহর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহর মৃত্যুতে গাজীপুরে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে স্থানীয় বিএনপি। গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল জানান, আ স ম হান্নান শাহর মৃত্যুতে গাজীপুর জেলা বিএনপি বুধবার থেকে গাজীপুরে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে। এ সময় দলের জেলা কার্যালয়সহ প্রতিটি উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। টানানো হবে কালো পতাকা। এছাড়া ওই তিনদিন সকল নেতাকর্মীকে কালো ব্যাজ ধারণ করার জন্য বলা হয়েছে। তার মৃত্যুতে গাজীপুর মহানগর জিয়া পরিষদের উদ্যোগে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে সকাল থেকে কোরান তেলাওয়াত করা হয়। মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আগামী তিনদিন এ কোরান তেলাওয়াত করা হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: