ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যাওয়া নয় ফিরে আসা-

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

যাওয়া নয় ফিরে আসা-

আবেদ খান ॥ খবরটা এলো অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো। হক ভাই আর নেই! জানতাম, তিনি থাকবেন না। তারপরও একটা প্রচণ্ড অবিশ্বাস আমাকে বিধ্বস্ত করে। আমি বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না- হক ভাইকে আর দেখব না। এই তো মাত্র তিনদিন আগে ২৪ তারিখে দুপুর বেলায় ইউনাইটেড হাসপাতালের ৬০৪ নম্বর কেবিনে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, তাঁকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, যে হক ভাইয়ের অবয়ব আমার বুকের মধ্যে গ্রথিত, সেই হক ভাই হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে থাকবেন এবং প্রতি মুহূর্তে তিলে তিলে এগোতে থাকবেন চরম পরিণতির দিকে- এ আমি মানতে পারছিলাম না। কেবিনের বাইরের চেয়ারে যখন বসেছিলাম, হক ভাইয়ের স্ত্রী আনোয়ারা ভাবি বললেন, ‘আপনার হক ভাইকে দেখবেন?’ ইতস্তত করে কেবিনের ভেতরে ঢুকলাম। হক ভাই পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। চক্ষুদ্বয় মুদ্রিত। ভাবি তাঁর গায়ে হাত বুলোচ্ছিলেন। হঠাৎ হক ভাই চোখ খুলে আমায় ইশারায় ডাকলেন, দুটো হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত চেপে ধরলাম। মুখ দিয়ে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন? সানজিদা কেমন আছে?’ উত্তরটা অন্যভাবেই বোধহয় দিতে হলো। বললাম, ‘হক ভাই, আপনি আমি আমরা সবাই ভালো আছি। আমরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছি, আপনার দিকে তাকিয়েই পথ চলছি।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘এই কিন্তু শেষ দেখা না। ধরে নিন এটা প্রথম দেখা।’ তাঁর অস্পষ্ট উচ্চারণ বুঝতে পারছিলাম না। ভাবি তাঁর হয়ে কথাগুলো বুঝিয়ে দিলেন। তারপর হক ভাই হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন। এরপরই মাত্র দুদিন গেল। হঠাৎ ২৭ তারিখে এসএমএস এলো- সৈয়দ হক নো মোর। ওই এসএমএস পড়ার পরে আমার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে এলো। হক ভাইকে আর দেখব না, তাঁর কোনো নতুন লেখা পড়ব না- এটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। সেদিন হাসপাতালে ভাবি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনার হক ভাই আজ সকালে লিখতে বসেছিলেন। আমি তাঁকে নিষেধ করি। তিনি বলেন, লিখতে আমাকে হবেই। চেতনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি লিখতে চাই।’ এর অল্প পরেই সৈয়দ শামসুল হক প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠিক সেসময় আমি গিয়েছিলাম হাসপাতালে। আমার সঙ্গে সাক্ষাত তার পরেই। কিছু কিছু জীবন থাকে, যা মৃত্যুকে অতিক্রম করে। কিছু কিছু স্মৃতি থাকে, যা সময়ের ধূলিকণায় আবৃত হয় না। কিছু কিছু বোধ থাকে যা সাহিত্য-সংস্কৃতি-দেশ এবং কালকে একত্রিত করে। সৃষ্টিশীলতা দিয়ে তার শক্তিমত্তা ও ব্যাপ্তিকে প্রকাশ করে। সৈয়দ শামসুল হক সেই মানুষ যিনি দেশ-কাল ব্যক্তিমানস ও জাতিমানসকে এক বিশেষ শৈল্পিক বৃত্তে আবদ্ধ করে অনুপম চিত্রকল্প দিয়ে রহস্য সঞ্চার করেন। তিনি তাঁর ভাবনার মধ্যে, ভাবপ্রকাশের মধ্যে ব্যক্তিপুরাণ স্বকাল ইতিহাস ও মানব সভ্যতার নানা কৌণিক সংশ্লেষ সংযুক্ত করেছেন। সব্যসাচী এই সৃজনশীল মানুষটি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ-ইতিহাস এবং গণমানুষের প্রতিবাদকে একত্রিত করেছেন- তার একটি নিদর্শন এখানে তুলে ধরা যায়। ‘ব্রহ্মপুত্রের প্রতি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘দশ লক্ষ ধর্ষিতার আর্তনাদে যখন নষ্টমান আমার শ্রুতি, তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তে যখন প্লাবমান আমার স্মৃতি, তিন কোটি মানুষের গৃহত্যাগে যখন বিলীয়মান আমার সভ্যতা, বলীবর্দের দ্বিখণ্ডিত খুরে কম্পমান আমার স্বপ্ন, তখন মহৎ ব্রহ্মপুত্র, স্মৃতিধর ব্রহ্মপুত্র আমার পিতামহের কৃষিপ্রতিভার আবিষ্কারক ব্রহ্মপুত্র কার কাছেইবা যাব আমি, তুমি ব্রহ্মপুত্র-তোমার কাছে ছাড়া।’ হক ভাই, আপনার চলে যাওয়া নয়, আপনার কাছেই ফেরত আসা। ২৭/০৯/২০১৬ লেখক : সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন
×