ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হিলারি-ট্রাম্প প্রথম বাগ্্যুদ্ধে দুই প্রার্থীর পরস্পরকে ঘায়েলের চেষ্টা

বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী

নাজিম মাহমুদ ॥ ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ প্রত্যয় নিয়ে আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার রাতে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল সাতটায়) প্রথমবারের মতো সরাসরি বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এনবিসি টেলিভিশনের লেস্টর হল্ট সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন। ৯০ মিনিটের এই বিতর্কে উভয় প্রার্থীই যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখান। একে অন্যের বিরুদ্ধে আগুনের ফুলকি ছড়ান। মোট ১০ কোটি দর্শক এই বিতর্ক প্রত্যক্ষ করেছে যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি রেকর্ড। কারণ, এর আগের নির্বাচনের ডিবেটগুলো এত লোক আর সরাসরি দেখেনি। খবর বিবিসি, এএফপি, সিএনএন ও ফক্স নিউজ অনলাইনের। এই বিতর্কে বর্ণবাদ, জাতিগত বিদ্বেষ, কর, কর্মসংস্থান, জলবায়ু, যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ নানা বিষয় স্থান পায়। একে অপরকে নানাভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। একে অপরকে ব্যঙ্গ করতেও পিছপা হননি। বিতর্কে একে অপরের শারীরিক সক্ষমতা ও অতীত জীবন নিয়ে কথা বলেন। সোমবারের এই বিতর্ক নিয়ে অন্তত ৫০ লাখ দর্শক টুইটস করেছে। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ টুইটস ছিল ট্রাম্পের সমালোচনা করে। ৩৮ শতাংশ টুইটস করে হিলারির সমালোচনা করে। বিতর্কে যখন কোন প্রার্থী শান্ত থাকার চেষ্টা করেছেন তখন অপর প্রার্থী তার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। বিতর্ক চলাকালে একজন অনর্গল বলে যেতে থাকলে আরেকজন তাকে থামিয়ে বিব্রত করার চেষ্টা চালান। বিতর্কের প্রথমদিকে হিলারির শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প। ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প বলেন, প্রেসিডেন্ট হওয়ার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি ও শারীরিক সক্ষমতা হিলারি ক্লিনটনের নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে গেলে প্রচুর শক্তি ও সামর্থ্য লাগে। উত্তরে ৬৮ বছর বয়সী হিলারি বলেন, ঠিক আছে আপনি (ট্রাম্প) ১২২ দেশ ভ্রমণ করুন, একটি শান্তিচুক্তি, একটি অস্ত্র বিরতি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের মুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতা করুন........কিংবা কংগ্রেসীয় কমিটির সামনে ১১ ঘণ্টা ধরে সাক্ষ্যের জন্যে ব্যয় করুন, এর পর সক্ষমতা নিয়ে কথা বলুন। হিলারি বলেন, ট্রাম্প নারীদের ‘শূকর,অলস ও কুকুর’ বলে হেয় করেছেন। হিলারির এই কথার জবাবে ট্রাম্প ব্যঙ্গ করে বলেন, হ্যাঁ, হিলারির অভিজ্ঞতা রয়েছে, তবে তা খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা। এই ট্রাম্পের হাতে পরমাণু শক্তি মোটেও নিরাপদ নয়। খ্যাতনামা ব্যবসায়ী ট্রাম্পের আয়কর রিটার্ন প্রসঙ্গ সামনে এনে হিলারি বলেন, ট্রাম্প তার আয়কর রিটার্ন প্রকাশ করতে যাবেন এটা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। কারণ, তিনি কিছু লুকাতে চান। এর জবাবে ট্রাম্প বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে হিলারির মুছে ফেলা ৩৩ হাজার ই-মেইল প্রকাশ করলে তিনি (ট্রাম্প) তার আয়কর বিবরণী প্রকাশ করবেন। হিলারি তার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এ অভিযোগের সংক্ষিপ্ত জবাব দেন। তিনি বলেন, এই ‘ভুলের’ কোন অজুহাত নেই এবং তিনি তার দায় নিয়েছেন। তবে বিতর্কিত আন্তঃপ্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে তার পরিবর্তিত অবস্থানের পক্ষে বলার সময়ও তিনি ইতস্তত ছিলেন। এর পর জঙ্গী সংগঠন আইএস নিয়ে হিলারিকে আক্রমণ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, জঙ্গী গ্রুপ আইএসকে দেখে নেয়ার কথা বলছেন? কিন্তু আপনি (হিলারি) যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন এটির অস্তিত্ব ছিল ক্ষুদ্র। আর এখন? ৩০টিরও বেশি দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। একে আপনি থামাতে পারবেন ? আমি মোটেই তা বিশ্বাস করি না। ট্রাম্প ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করেন এবং ক্ষমতায় গেলে ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত করতে ইরাকের সব তেল তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন। উত্তর কোরিয়াকে থামাতে চীনের সাহায্য নেয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করেন। ট্রাম্প বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রকে একটি মহান দেশ হিসেবে গড়তে চাই। তবে হিলারির এই সামর্থ্য রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এই অভিযোগের উত্তরে হিলারি বলেন, আইএস জঙ্গী নির্মূলে বিমান হামলা জোরদার করা হয়েছে। আমরা আশা করছি চলতি বছরের মধ্যেই ইরাক থেকে আমরা আইএস নির্মূল করতে পারব। মুসলিমদের বিষয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে সমালোচনা করেন হিলারি। তিনি বলেন, ট্রাম্প মুসলিমদের প্রতিনিয়ত অপমান করে যাচ্ছেন। আমরা যখন মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছি, আমাদের যখন মুসলমানদের সহায়তা প্রয়োজন পড়ছে তখন এই রিপাবলিকান প্রার্থী মুসলিমদের দেশ এবং দেশের বাইরে অপমান করে চলেছেন। গত বছর নির্বাচনী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে ট্রাম্প বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট হলে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞারোপ করব। এরপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলেন হিলারি। হিলারি বলেন, পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সখ্য রয়েছে। তিনি বলেন, সন্দেহের কোন কারণ নেই যে, রাশিয়া মার্কিন টার্গেটে সাইবার আক্রমণ চালাচ্ছে। কিন্তু পুতিনকে প্রতিনিয়ত প্রশংসা করে যাচ্ছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পকে ঘায়েল করতে তার বর্ণবাদ নীতি নিয়ে কথা বলেন হিলারি। হিলারি বলেন, আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম যখন ট্রাম্প প্রকাশ্যে আমেরিকানদের তথ্য হ্যাক করার জন্য পুতিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এটা অগ্রহণযোগ্য। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। তিনি বলেন, ট্রাম্প বর্ণবাদী। মিথ্যা কথা দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে আমেরিকান নন বলে উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিন ধরে চলা জোটের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে যে মন্তব্য করেছেন তার সমর্থনে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, জাপানের মতো দেশগুলোর অবশ্যই এর জন্য ব্যয় বহন করতে হবে। ট্রাম্প বলেন, আমরা সারাবিশ্বে পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে পারি না। আমরা সারা বিশ্বের দেশগুলোকে রক্ষা করতে পারি না। তাছাড়া এক্ষেত্রে আমাদের যা প্রয়োজন তাও মেটাচ্ছে না ওসব দেশ। হিলারির এই বক্তব্যের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে সূচক বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিলারির সমর্থনে সমাবেশ হয়েছে। হিলারির বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মেরকেলসহ অন্যান্য বিশ্বনেতা। দুই প্রার্থীর মধ্যে এই বিতর্কের ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক ভোটারের সিদ্ধান্ত। তিন পর্বের বিতর্ক দেখেই দেশটির ভোটারদের প্রায় ৫০ শতাংশ সিদ্ধান্ত নেবেন, কাকে ভোট দেয়া যায়। সুতরাং, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও শুরু হলো মার্কিন মুলুকে। চলতি বছরের ৮ নবেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচনী জরিপগুলোতে দুই প্রার্থীর পক্ষে কাছাকাছি জনসমর্থন লক্ষ্য করা গেছে। সর্বশেষ জরিপে হিলারির পক্ষে ৪৮ শতাংশ আর ট্রাম্পের পক্ষে ৪৬ শতাংশ সমর্থনের কথা বলা হয়েছে। তাৎক্ষণিক জরিপে এগিয়ে হিলারি ॥ এই দুই প্রার্থীর প্রথম টেলিভিশন বিতর্ক শেষে হিলারিকে বিজয়ী বলছেন অধিকাংশ দর্শক। সিএনএন/ওআরসির এক জরিপে বিতর্ক দেখা দর্শকের ৬২ শতাংশ হিলারি আর ২৭ শতাংশ ট্রাম্পকে জয়ী বলে রায় দিয়েছেন। পাশাপাশি বিবিসির জরিপেও এগিয়ে রয়েছেন হিলারি।
×