ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ গোপাল দত্ত

বাপ কা বেটি

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বাপ কা বেটি

একটি প্রবাদ আছে খরশব father like son. কিন্তু বাংলাতে যদি আমরা বলতে যাই, বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রিয় আপা, শেখ হাসিনার কথা বলতে যাই তাহলে বোধহয় একটু উল্টিয়ে বলতে হবে খরশব ভধঃযবৎ ষরশব ফধঁমযঃবৎ। অনেক বিষয়েই পিতা এবং কন্যার বহু মিল রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে দিকটি আমার চোখে পড়েছে সেটা হলো দু’জনেরই শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। বঙ্গবন্ধুর শিশুদের প্রতি যে ভালবাসা ছিল সেটা আমি দেখিনি, সেটা শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই দেখেছিলেন, যার জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবসটাকে জাতীয় শিশু কিশোর দিবস হিসেবে তিনি উৎসর্গ করেছেন। দিবস করেই ক্ষান্ত হননি, শিশু কিশোরদের এক আবহ এই দেশে তিনি ঘটিয়ে দিয়েছেন- যা কি-না ভাষায় বর্ণনা করার নয়। আমি দেখেছি আমাদের প্রিয় নেত্রীকে, অটিজম নিয়ে আন্দোলন করার সুবাদে, সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের নেতৃত্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশুদের কতটুকু ভালবাসেন। সুস্থ বা দেবতুল্য অথবা বিশেষভাবে অটিজম শিশুদের প্রতি তাঁর কি অকৃত্রিম ভালবাসা, ¯েœহ, মায়া ও মমতা। ২ এপ্রিল অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজম নিয়ে বাংলাদেশে আমাদের কাজ শুধু পৃথিবীর প্রায় সব দেশের শেষে অর্থাৎ মাত্র ২০০৯-’১০ সাল থেকে আমরা এই নিয়ে কাজ শুরু করি। নির্দেশনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। সূচনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর নিউরো ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড চিলড্রেন। তারপর ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের মাধ্যমে আমাদের যাত্রা এবং ঢাকা ডিকলারেশনের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া এবং অটিজম নিয়ে কাজ করেন বিশ্বের প্রায় সমস্ত সংগঠন জেনে গেল বাংলাদেশে তার কাজ শুরু হয়েছে শিশু মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের নেতৃত্বে। ২০১১ থেকে ২০১৬ শুধু ৫টি বছরে আমাদের অগ্রগতি পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের কাছে ঈর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এমনকি সায়মা ওয়াজেদ হোসেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যানের মানসিক রোগ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও মনোনীত হয়েছেন। সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিওনাল অফিস থেকে তিনি এক্সট্রা অর্ডিনারি পাবলিক হেলথ এ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। সর্বশেষ তার নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক যে কনফারেন্সটি সেটি ভুটানে করার জন্য সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিয়নাল ডাইরেক্টর পুনম ক্ষেত্র পাল সিং তাকে অনুরোধ করেছেন। অর্থাৎ তার যোগ্যতা, প্রজ্ঞা এবং মেধার বিচার আজ সর্বজনস্বীকৃত। বলছিলাম শিশু-কিশোরদের নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভালবাসার কথা। সত্যিকার মায়ের যে একটা রূপ সেই রূপটি আমরা দেখতে পেয়েছি তাঁর মধ্যে। যে কোন শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার মতো মা, শেখ হাসিনাকে আমি দেখেছি। বিশেষ করে অটিজম অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী অথবা স্থায়ুবিক দুর্বলতার জন্য যে সব শিশুকে নিয়ে আমরা অটিজম সচেতনতা দিবসের কার্যকলাপ করি সেই, অনুষ্ঠানগুলোতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর উপস্থিতি যেমন দর্শক-শ্রোতাদের প্রাণমুগ্ধ করে, তেমনি ঐসব শিশু-কিশোরের মনেও তিনি এক আশার সঞ্চার করে দেন। তাঁর নির্দেশনায় সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পুরো বাংলাদেশে একটি সমীক্ষা হয়েছে যে সমীক্ষার ফলাফল নিবন্ধিত হয়েছে। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এখন ওয়েবসাইট দেখেই বলে দিতে পারব কোন্ জেলার, কোন্ থানার, কোন্ গ্রামে কয়টি অটিস্টিক অথবা নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসএবিলিটির চিলড্রেন আছে। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ ব্যাপারে সচিব নাসিমা বেগম এবং তার টিম অশেষ ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। হয়তবা রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। কারণ, স্বল্প দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ডাক্তার এবং মাঠকর্মীদের দ্বারা এটা করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস এরই মধ্যে আমরা যে সূচনাটা করেছি, যে সমীক্ষা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় করে দিয়েছে, তাকে ভিত্তি করে ভবিষ্যতে আরও সঠিক অনুসন্ধান এবং সমীক্ষা বা জরিপ করা যাবে। অটিস্টিক শিশুদের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে তিনি এসেই প্রথম ঐসব শিশুদের কাছে যান। তাদের গালে মাথায় আদরের পরশ বুলিয়ে দেন। তাঁকে পেলে শিশুরাও তাঁকে জড়িয়ে ধরে থাকেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এসব শিশুর বেশিরভাগই কিছুটা আচার ব্যবহারের দিকে ভায়োলেন্ট হন। অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত থাকেন। ২০১০-এর পর থেকে এ পর্যন্ত যত অনুষ্ঠান হয়েছে, কোন অনুষ্ঠানই কোন একটি শিশুকে যারা বিশেষায়িত শিশু তাদের কোন রকমের অভদ্র আচরণ করতে আমি দেখিনি। এটা বোধহয় বিশেষ করে ‘মা’দেরকে মাতৃত্বের গুণাবলীর পাশাপাশি যে আরও একটা কোন গুণ অর্থাৎ মায়াবী গুণ দিয়ে থাকেন, সেই গুণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমৃদ্ধ। অনেক ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা উল্লেখ করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন যে তাঁর শিশুদের প্রতি ভালবাসা। শিশুরা শেখ হাসিনার প্রতি কত বিনম্র এবং তাঁকে কতটুকু শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করেন। গত বছরের অটিজম সচেতনতা দিবসে অর্থাৎ ২০১৫ সালের অটিজম সচেতনতা দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে একটি অটিস্টিক শিশু মঞ্চে উঠে গেলেন। এবং তাঁর পাশে ঘুর ঘুর করলেন। তিনি তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদের বললেন তাকে পাশে বসতে দিন এবং শিশুটি সেখানে বসল। কোন রকমের বিশৃঙ্খল আচরণ একজন দর্শকও পাননি। উল্টোদিকে তার মা এবং স্কুলের শিক্ষকরাও অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। কারণ সে হঠাৎ করে কাউকে মার দেয়। সেই রকম একটি ঘটনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘটে যায় কি-না। প্রধানমন্ত্রী যখন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখনও সে তাঁর পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো অনুষ্ঠানের শেষে প্রধানমন্ত্রী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার জন্য যখন তার স্বীয় আসনে এসে বসলেন, ঐ সময়ে ডায়াচে আর্মি মিউজিক ব্যান্ডের একজন সৈনিকের লম্বা বাঁশিটি শিশুটি টেনে নিয়ে চলে আসল। পুরো অনুষ্ঠানটি চলল বংশী বাদকের ঐ বাঁশি ছাড়া। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বহরের কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে এনে কাছে বসালেন। পুরো অনুষ্ঠানটি সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বসে উপভোগ করল। জাস্ট পেছনের সারিতে বসে সিকিউরিটির লোকজন শুধু তার হাত, বাঁশি আর দেহের প্রতি নজর রাখছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে বুকে জড়িয়ে আরও আদর করলেন এবং সে বাঁশিটি ঐ ব্যক্তির হাতে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। একি অপরূপ এক দৃশ্য। ভয়াবহতাকে কিভাবে কাটিয়ে তিনি এ শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে আদর করলেন। এটা একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন। তার উপরে যারা বলতে পারবেন স্বয়ং বিধাতা। আরও দেখেছি যখন কোন টিকা প্রদান অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে যদি উদ্বোধন করা হতো অথবা ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কোন অনুষ্ঠানে তিনি অপরিচিত শিশুদের যখন বুকে ধরে ওষুধ খাওয়াতেন কোন একটা শিশু কখনও কাঁদা তো দূরের কথা বিরক্তির ভাবও পোষণ করেননি। এখানে বিন্দুমাত্র অতিরিক্ত বর্ণিত হয়নি। কারণ, আপনারাও তা টেলিভিশনে দেখেছেন। তাই বলি প্রধানমন্ত্রীর অনেক দুর্ভাগ্যের মধ্যেও একটি সৌভাগ্য শিশুরা তাঁকে ভালবাসেন এবং তিনিও শিশুদের প্রচ-ভাবে ভালবাসেন। মাতৃস্নেহে তিনি শিশুদের কাছে টেনে নিয়ে আসেন। কোন শিশুই তাঁর কাছে দুর্ব্যবহার বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতে পারে না। ভালবাসা বা আদর যত্ন দিতে জানলে সেই রূপ পাওয়াও যায়। লেখক : সাবেক ভিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
×