ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মনের দরজা খুলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ এখন সামনে...

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মনের দরজা খুলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ এখন সামনে...

জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজন রেখা মিটিয়ে নারীদের সংহত ও সংগঠিত করার মাধ্যমে লাইবেরিয়ার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ বন্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণই শান্তিতে নোবেল জয়ের মূল কারণ লেমাহ বোয়ির। তিনি ২০১১ সালে নোবেল জয় করেন। লাইবেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর আগ থেকে পশ্চিম আফ্রিকায় নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কাজ করে আসছেন মানবাধিকার কর্মী লেমা। নারীদের সংগঠিত করার মাধ্যমে ২০০২ সালে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলরকে গৃহযুদ্ধের অবসানে চাপ প্রয়োগ করার অবদানও তারই। আর এই নারীরা ছিলেন যুদ্ধে অংশ নেয়া দুই পক্ষের যোদ্ধাদের মা, স্ত্রী কিংবা বোন। লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধ বিপর্যস্ত দেশটিতে যুদ্ধ-পরবর্তী ২০০৫ সালের নির্বাচনে এলেন জনসন সারলিফের পক্ষে প্রচারে খ্রীস্টান ও মুসলিম সমর্থকদের নিয়ে এই লেমা বোয়ি ১৫টি প্রদেশে কাজ করেন। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত উইমেন পিস এ্যান্ড সিকিউরিটি নেটওয়ার্ক আফ্রিকা নামে মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা তিনি। মূলত এটি পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে নারীদের নিয়ে কাজ করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন এই লাইবেরিয়ান শান্তিকর্মী। লিবিয়ায় যে জনপদে আমরা বেড়ে উঠেছি, সেটা দেখতে অনেকটা গ্রামের মতো। যদিও জায়গাটা শহরে। দাদি আমাদের দেখাশোনা করতেন। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মিশতেন। তাই ভিন্ন ভিন্ন পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, আচার-ব্যবহারসম্পন্ন মানুষের নিয়মিতই আমাদের বাসায় যাতায়াত ছিল। দাদি প্রায়ই রাস্তার ওপারে এক বৃদ্ধার কাছে বেড়াতে যেতেন। বৃদ্ধা ভুতুড়ে গাছগাছালিতে ঘেরা একটা জঙ্গলে থাকতেন, তাই লোকে তার কাছে যেতে ভয় পেত। একদিন এক বন্ধু বলল, বৃদ্ধা নাকি ডাইনি! সে ছোট শিশুদের ধরে খেয়ে ফেলে! কথা ছিল, আমরা দুই বোন এই ভয়ঙ্কর তথ্যটা গোপন রাখব। কিন্তু আমরা দুজন ঠিক করলাম, ব্যাপারটা দাদিকে বলব। বললাম। দাদি ধৈর্য নিয়ে আমাদের সব কথা শুনলেন। পরদিন সকালে তিনি বললেন, ‘চলো। আজ আমরা ওই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে যাব।’ আমরা দুই বোন মাটিতে পড়ে কাঁদতে শুরু করলাম। বললাম, কিছুতেই যাব না। দাদি কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি আমার সঙ্গে না আসো, জীবনের সবচেয়ে উঁচু স্বরের কান্নাটা আজই তোমাদের কাঁদতে হবে।’ দাদি জোর করে আমাদের সঙ্গে নিলেন। সেদিন থেকে শুরু“ করে বৃদ্ধার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমরা তার বাসায় যাওয়া বন্ধ করিনি। আজ আমার বক্তব্যের বিষয় ‘দ্য ওপেন মাইন্ড চ্যালেঞ্জ’। আমরা একটা ঝঞ্ঝাটপূর্ণ পৃথিবীতে বাস করছি। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমÑ সব দিকে কেবল সমস্যা আর সমস্যা। আফ্রিকা মহাদেশের ২৯টি দেশে যুদ্ধ চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে ২৬৭টি বিদ্রোহী দল নানা দাবিতে লড়াই করছে। ইউরোপের ১০টা দেশে ৮০টি বেসামরিক বাহিনী আছে। এশিয়ার ১৬টি দেশে সক্রিয় আছে ১৬৪টি বিদ্রোহী বেসামরিক দল। এমন আরও বহু উদাহরণ আমি দিতে পারি। কারণ এসব ভয়ঙ্কর ঘটনাই আমাকে রাগিয়ে তোলে আর কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। জানুয়ারি থেকে জুন- এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে ৬৭১টি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। ইরাকে আড়াই শ’ মানুষের শিরñেদ করা হয়েছে এক দিনে। এমন একটা পৃথিবীতে আমাদের বাস করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ‘পৃথিবীর আসলে হয়েছেটা কী?’ এর মূল কারণ আমার আর ‘আমার চেয়ে অন্য রকম’- এই দুইয়ের মাঝখানে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেয়া। দেশে দেশে তো সীমানা আছেই। আমরা আমাদের সম্প্রদায়, স্কুল এমনকি দুঃখজনকভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও দেয়াল তুলে দিয়েছি। ভয় আর বিভাজনের রাজনীতি সব দখল করে নিয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা আমাদের সাধারণ মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি। উদ্বাস্তু অথবা অভিবাসীদের নাম শুনলেই আমরা ভীত হই। কোন কিছু ভালভাবে না জেনেই মানুষ একটা উপসংহারে পৌঁছে যায়, যেটা নেতিবাচক অনুভূতি ছড়ায়। এখন আমাদের সময় সবকিছু ভালভাবে জানার। স্রোতে গা ভাসিয়ো না। সত্যটা না জেনেই কাউকে তোমার প্রতিপক্ষ ভেব না। এখন আমাদের ‘ওপেন মাইন্ড চ্যালেঞ্জ’ নেয়ার সময়। বিভাজন তৈরির বদলে আমাদের বরং ভয়ের সীমানা পেরোতে হবে। অদৃশ্য দেয়াল ভেঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। লাইবেরিয়ায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘যে পথিক প্রশ্ন করতে জানে, সে কখনও পথ হারায় না।’ স্নাতক বন্ধুরা, মনের দরজা খুলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পৃথিবীকে শান্তির দিকে এগিয়ে নেয়াই আজ তোমাদের দায়িত্ব। শ্রদ্ধেয় দালাই লামা বলেন, ‘শান্তি আমরা সবাই চাই। কিন্তু কীভাবে শান্তি মিলবে- ভেবে প্রায়ই দ্বিধান্বিত হই। পরস্পর বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের মধ্যেই আসলে শান্তি নিহিত।’ যখন ছোট ছিলাম, আমি আর আমার বোন রাস্তা পেরিয়ে সেই বৃদ্ধার কাছে যেতে ভয় পেতাম। কারণ এমন একটা সমাজে আমরা বাস করতাম, যেটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেয়, আর না জেনেই অদ্ভুত সব গালগপ্প তৈরি করে। সত্যটা জানতে ঘরের আরাম ফেলে কষ্ট করে আমাদের রাস্তা পেরোতে হয়েছে। আমরা জেনেছি, সেই বৃদ্ধা তার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে থাকেন। তিনি এতটাই অসুস্থ যে হাঁটতেও পারেন না। রাস্তা পেরিয়ে তবেই আমরা জেনেছি, কিছু ঠকবাজ প্রতারণা করে তার সহায়-সম্পদ দখল করে নিয়েছে। জঙ্গলে থাকাটাই ছিল তার প্রতিবাদ। আমরা জেনেছি, অতিথির জন্য তিনি পথ চেয়ে বসে থাকতেন। কেউ এলে তার সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতেন। জানতেও চাইতেন না, ‘আপনি কে? কোথা থেকে এলেন?’ আমি আর আমার বোন যদি সেদিন রাস্তা না পেরোতাম, এগুলো আমাদের জানা হতো না। দাদি সেদিন আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা সেদিন আমরা পেয়েছি, আর তা হলো মনের দরজা খুলে দেয়ার শিক্ষা। তরুণরা, মনের দরজা খুলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ এখন।
×