ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতের রায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই

দখল-দূষণে মৃতপ্রায় চট্টগ্রামের পাঁচ নদী

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দখল-দূষণে মৃতপ্রায় চট্টগ্রামের পাঁচ নদী

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এটি সর্বজনস্বীকৃত। ছোট বড় অসংখ্য নদীর সমাহার এ দেশে। কিন্তু নদী শাসন ব্যবস্থা ও নদী রক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ ও আইনের কার্যকারিতার অনুপস্থিতিতে ইতোমধ্যে দেশে বহু নদীর তলদেশ ভরাট ও দু’পাশ দখল হয়ে যাওয়ায় এগুলোর মৃত্যু ঘটেছে। রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গাকেও বিশেষজ্ঞরা মৃত আখ্যা দিয়েছেন ইতোমধ্যে। অনুরূপভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ৫ নদীর অবস্থাও করুণ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু, ইছামতি ও কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর দখল ও দূষণ যেন অপ্রতিরোধ্য। কর্ণফুলী ও বাঁকখালী নিয়ে উচ্চ আদালতে রায় ও দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে গতিও লক্ষণীয় নয়। ফলে পলি ও বর্জ্য দূষণ দুটি নদী প্রতিনিয়ত মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আর দখলের গতিও যেন থামছে না। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী অপরিশোধিত বর্জ্য এবং ধাতুর পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে এসব নদীর পানিতে ক্রোমিয়ামের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে তা সহনীয় পর্যায় ছাড়িয়ে গেছে। দখল ও দূষণ আগ্রাসনে এসব নদীর আকার খালে রূপ নিচ্ছে। পাশাপাশি নদীর পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দেশের গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর মরণ দশা নিয়ে গলা ফাটিয়ে জানান দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে যেন কোন মহলের কোন দায় দায়িত্ব নেই। পরিস্থিতি একেবারে কঠিন পর্যায়ে আসার পর নদী দখল ও দূষণের বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে। আদালত বুড়িগঙ্গা নদীর পর কর্ণফুলী নদীর দখল ও দূষণ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনার রায় প্রদান করেছেন। সে রায়ের এক মাস ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু দখল ও দূষণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর কার্যকর কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। তবে আদালত তিন মাস সময় দিয়েছেন। নদী রক্ষায় বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে গতিতে কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে এতে দেশের অর্থনীতির মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ কর্ণফুলী নদীর বড় একটি অংশ চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যে চ্যানেল দিয়ে দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে থাকে। সঙ্গতকারণেই কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম বন্দরে প্রাণ প্রবাহিনী শিরা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের মুখ থেকে উজানে সদরঘাট এলাকা পর্যন্ত চ্যানেল হিসেবে বলা হলেও গভীরতা না থাকায় বড় বড় জাহাজের আগমন ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বহির্নোঙরে নোঙর করে এসব জাহাজ থেকে লাইটারিংয়ের মাধ্যমে পণ্য গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। অপরদিকে, হালদা নদী হচ্ছে হাটহাজারী ও রাউজানের মাঝপথ দিয়ে প্রবাহিত। এ নদী দেশের মিঠাপানির মাছের প্রজননের একমাত্র আধার। এর দুই পার দখল ও দূষণে ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হালদা নদীতে মৎস্য প্রজননের বিষয়টি দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহুল আলোচিত। বড় বড় মা মাছ অতি মৌসুমে এ নদীতে এসে ডিম ছাড়ে। যা সংগ্রহ করে রেণুতে পরিণত করে সারাদেশে সরবরাহ হয়। হালদা নদীকে রক্ষায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ পর্যন্ত হৈ চৈ কম হয়নি। কিন্তু সফলতা আসেনি। অপরদিকে, কর্ণফুলী নদীর দখল ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে উচ্চ আদালত ১৯৯০ সালে একবার নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু সে নির্দেশনা কাগজেই রয়ে গেছে। এর প্রায় ২৫ বছর পর চলতি বছরের ১৬ আগস্ট হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ কর্ণফুলীর দুই তীরের ২১৮১ অবৈধ স্থাপনা আগামী তিন মাসের মধ্যে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি অপরিশোধিত বর্জ্য নিঃসরণ প্রক্রিয়া বন্ধের দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), বিআইডব্লিউটিএ ও পরিবেশ অধিদফতর। কিন্তু এসব সরকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাবটি এ ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা হয়ে আছে। ফলে এ পর্যন্ত কার্যকর কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। তবে জেলা প্রশাসন, চসিক, চউক, পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে সোমবার জানানো হয়েছে হাইকোর্ট প্রদত্ত সময় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কি প্রক্রিয়া চলছে এমন প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ স্থাপনার তালিকা ও কর্ণফুলী নদীর সীমানা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি ছাড়াও অন্য কোন ব্যবস্থার বিষয়ে জানাতে পারেনি। চউক ও চসিক এ নিয়ে তাদের কোন দায়িত্ব আছে কিনা সে নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অপরদিকে, কক্সবাজার শহর ঘেঁষা বাঁকখালী নদী দখল ও দূষণে বহু আগে থেকেই অর্ধমৃত অবস্থায় রয়েছে। ২০১৪ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাঁকখালী নদী নিয়ে সরকারের ওপর রুল জারি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু গত দুই বছরেও আদালতের সে নির্দেশনা অনুসারে এ নদীকে রক্ষার ক্ষেত্রে কোন কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে বলে বলা যায় না। শহরের সমস্ত আবর্জনা বাঁকখালী নদীতেই ফেলা হয়। ফলে বিষাক্ত বর্জ্যে এ নদীর তলদেশ একদিকে যেমন ভরাট হচ্ছে, তেমনি ক্রোমিয়ামের পরিমাণও বাড়ছে। এছাড়া নদীর দুই তীরে যেখানে অবৈধ দখল বন্ধ হওয়ার কথা সেখানে নতুন জেগে ওঠা চরের দখল নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে আছে। সূত্র জানায়, সাঙ্গু ও ইছামতি নদীও গুরুত্বপূর্ণ। এ তিনটি নদী দিয়ে বহুমুখী কর্মকা- চলছে দশকের পর দশক ধরে। এই তিন নদীর অস্তিত্ব রক্ষা এবং দু’পাড়ে অবৈধ দখল বন্ধে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি কম উঠেনি। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়ে আছে। হালদা, ইছামতি ও সাঙ্গুর আগ্রাসি তৎপরতায় জনজীবন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি এসব নদী থেকে প্রাপ্ত সুফলেরও শেষ নেই। কিন্তু ক্রমাগতভাবে এসব নদীর আকার যেমন ছোট হচ্ছে তেমনি তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম মহানগর ঘেঁষা কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তি শুধু আসামের লুসাই পাহাড় থেকে। এ নদী এসে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। শেষ হয়েছে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার শেষ প্রান্তে সাগর সংলগ্ন মোহনায়। মাঝপথে কাপ্তাই চন্দ্রঘোনায় প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার বৃহত্তম কাগজের কল কেপিএমের (কর্ণফুলী পেপার মিল) বর্জ্য দূষণ এ নদীকে যেন টুঁটি চেপে মেরে ফেলছে। এরপরে চট্টগ্রাম মহানগরী সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হতে গিয়ে কর্ণফুলী নদীকে গিলে খাচ্ছে অবৈধ দখলদাররা। বিষাক্তসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হতে থাকার কারণে এ নদীর পানি ক্রমাগতভাবে দূষণের শিকার। জনস্বার্থে উচ্চ আদালত এ পর্যন্ত দুই দফায় বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। নদী রক্ষায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যত কোন সুফল লক্ষণীয় নয়। গত ২৪ সেপ্টেম্বর দেশে বিশ্ব রক্ষা দিবস পালিত হয়ে গেল। প্রতিবছর এ দিবস ঘটা করে পালিত হয়। কর্ণফুলী ও হালদার ব্যাপারে ব্যতিক্রমধর্মী সাম্পান র‌্যালিও হয়েছে বহুবার। কিন্তু দূষণ ও দখল থেকে মুক্তি মিলছে না। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক পদে রদবদল ঘটেছে। বিদায়ী জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ আশাবাদ ব্যক্ত করে গেছেন কর্ণফুলী নদী নিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়নে প্রশাসন এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক যোগদান করেছেন। তিনি নতুন করে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করবেন এবং আদালত প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী অপর তিনটি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে তৎপর হবেন বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র।
×