ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাক্রিডিটেশন আইন-২০১৫’ খসড়া চূড়ান্ত;###;বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে

চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কাউন্সিল হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কাউন্সিল হবে

নিখিল মানখিন ॥ দেশের বেসরকারী চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাক্রিডিটেশন আইন-২০১৫’ এর খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এটি বর্তমানে মন্ত্রিসভায় পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ আইনের আওতায় চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে মেডিক্যাল এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইন কার্যকর হলে বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। অধিকাংশ কলেজ নিজেদের তৈরি নিয়মে চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কাউন্সিলের অধীনে ‘চিকিৎসা শিক্ষা’ ও ‘স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান’ নামে পৃথক দুটি বিভাগের মাধ্যমে সারাদেশের বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান মনিটরিং, সুপারভিশন ও মান নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আবেদন সাপেক্ষে সরেজমিন পরিদর্শন ও যাচাই বাছাইয়ে সন্তুষ্টি সাপেক্ষে এ্যাক্রিডিটেশন সনদ দেয়া হবে। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিলের বৈঠক হয়। পদাধিকার বলে তিনি ওই কাউন্সিলেরও সভাপতি। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে স্বাস্থ্যখাতের অধিকতর উন্নয়নে করণীয় সম্পর্কে মতামত জানতে চান। বৈঠকে একাধিক বক্তা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারী পর্যায়ে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল, হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক গজিয়ে ওঠার বিষয়টি জানিয়ে বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সব শুনে প্রধানমন্ত্রী পৃথক মেডিক্যাল এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর মেডিক্যাল কাউন্সিল গঠন ও খসড়া আইন প্রণয়নের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আইয়ুবুর রহমান ভুইয়াকে সভাপতি করে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে মূল কমিটির সুপারিশ ও প্রস্তাবে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি সাব-কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাক্রিডিটেশন আইন-২০১৫ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক ডাঃ মোঃ ইসমাইল খান, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার ডাঃ জাহেদুল হক বসুনিয়া, সেন্টার ফর মেডিক্যাল এডুকেশন পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সাইফুল ইসলাম ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের প্রধান আসাদুল ইসলাম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে বর্তমানে ১০০টি মেডিক্যাল (সরকারী ৩০, বেসরকারী ৬৪ ও আর্মড ফোর্সেস ৬টি) ও ৩৩টি ডেন্টাল (৯টি সরকারী ও ২৪টি বেসরকারী) কলেজ রয়েছে। এছাড়া ৭৪টি নার্সিং ইনস্টিটিউট, ১০৩টি মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ও ৯৭ হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা শিক্ষা এ সব প্রতিষ্ঠানের দেখভালের দায়িত্বে থাকলেও জনবলের দোহাই দিয়ে তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। ন্যূনতম অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ ও ল্যাবরেটরি সুযোগসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও বহু প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর চলছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। জানা গেছে, এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলে সাংসদ, মেডিক্যাল চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষক, এ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, বিএমডিসি, বিসিপিএস, বিএমএ, বিএমআরসি, ফার্মেসি কাউন্সিল, ডেন্টাল সোসাইটি, নার্সিং কাউন্সিল, স্টেট ফ্যাকাল্টি, কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি সংগঠনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি সাবেক বিএমএ সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশীদ-ই- মাহবুব বলেন, বিএমডিসিসহ সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে। পৃথক মেডিক্যাল এ্যাক্রিডিটেশন গঠিত হলে কারা এটি পরিচালনা করবে, তাদের কাজ কী হবে সে সম্পর্কে আগে ধারণা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিশেষজ্ঞরা জানান, বেসরকারী মেডিক্যাল শিক্ষা আজ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনে অনিয়ম ও দায়িত্বহীনতার কারণে দেশের কতিপয় অসাধু চক্র এই সেক্টর নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছিল। ওই সময় হাসপাতাল থাকলেই মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন মিলেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারী ও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশে সরকারী যেমন- তেমন বেশির ভাগ বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাদান, পরীক্ষা গ্রহণসহ নানা কর্মকা- নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কোন শেষ নেই। খুবই আকস্মিক ও অপরিকল্পিতভাবে অনেকটা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়েছে। হাতে গোনা দু-চারটি ছাড়া বাকি সব বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজকে ঘিরে চিকিৎসাশিক্ষা বাণিজ্যের যে হাট বিস্তৃতি লাভ করেছে, তা দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেক্টরের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় বড় শহরে ১৯৯১ সাল থেকে এই যে বেসরকারী এতগুলো মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হলো তা কতটুকু প্রয়োজন আর পরিকল্পনামাফিক হয়েছে, এসব প্রশ্নকে কোনক্রমেই উপেক্ষা করা যাবে না। এ ধরনের একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিষয়টিকে যখন হঠাৎ যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতা গজিয়ে ওঠার সঙ্গে হরহামেশা তুলনা করা হয়। গত ৪৪ বছরে, বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পর আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা দানোপযোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেযোগ্য হারে। বেশির ভাগ বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের অবকাঠামো, লেখাপড়ার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষার্থী ভর্তি, পরীক্ষাসহ যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার যেন শেষ নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে চিকিৎসাশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের বিষয়টি দায়িত্বশীল কারও কাছেই কখনও গুরুত্ব পায়নি। চিকিৎসাশিক্ষা কিংবা চিকিৎসাসেবার এতগুলো ঐতিহ্যবাহী ও খ্যাতনামা প্রতষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও আত্মনির্ভরশীল হওয়া তো দূরের কথা, এ দীর্ঘ সময়ে এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম আস্থাটিও বোধ করি অর্জন করতে পারিনি। আর এ কারণে চিকিৎসাশিক্ষা বা চিকিৎসাসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে বলতে গেলে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে নানা অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক ঘটনা। দেশে স্বাস্থ্যসেবার এত সব উদ্যোগ-আয়োজন থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও অন্য সামর্থ্যবানসহ বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য যে ঘন ঘন বিদেশে যাতায়াত করেন সেটাও মূলত অনাস্থা, অবিশ্বাস ও সন্দেহের কারণেই। চিকিৎসা যেমন-তেমন, এটা কেমন কথা যে দেহে কোন রোগবালাই আছে কি না তা শনাক্ত করতেও বিদেশের হাসপাতালগুলোর শরণাপন্ন হতে হবে? তাই জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ ও বিভাগে বিভাগে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও আগে নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ও সেবার মান নিশ্চিত করা কিংবা বাড়ানোটা আজ বোধ করি জরুরী হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
×