ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মালিকের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ

ট্যাম্পাকোর ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও তিন কঙ্কাল উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ট্যাম্পাকোর ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও তিন কঙ্কাল উদ্ধার

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম ॥ ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানার ধ্বংসাবশেষ থেকে ঘটনার ১৬ দিন পর সোমবার দুপুরে আরও তিন ব্যক্তির কঙ্কাল উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। মৃতদেহ গলে যাওয়ায় এবং আগুনে ও কেমিক্যালে পুড়ে যাওয়ায় সেগুলো নারী না পুরুষের তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিচয়পত্র, ব্যাংকের এটিএম কার্র্ড, চাবির গোছা, মাথার খুলিতে আটকে থাকা দাড়িসহ বিভিন্ন আলামত থেকে ওই তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এদের নাম নিখোঁজ ১১ জনের তালিকায় রয়েছে। তবে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্টের জন্য স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর না করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে ওই কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এদিকে ঘটনার ১৭তম দিন সোমবারও নিখোঁজদের সন্ধানে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যৌথভাবে ‘ফায়ার ফাইটিং এ্যান্ড রেস্কিউ অপারেশন’ চালিয়েছে। অপরদিকে সোমবার কারখানার মালিকের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সোমবার যে তিনজনের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে তারা হলেন- কারখানার মেশিন অপারেটর ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার ভিমনগর গ্রামের মোজাম মোল্লার ছেলে চুন্নু মোল্লা (২১), সিনিয়র অপারেটর চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পলাখান গ্রামের ইউসুফ পাটোয়ারীর ছেলে নাসির পাটোয়ারী (৩৫) ও প্রিন্টিং অপারেটর সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর থানার জিগারবাড়িয়া গ্রামের সুলতান গাজীর ছেলে আনিসুর রহমান (৩০)। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আক্তারুজ্জামান লিটন ও টঙ্গী মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, টঙ্গীর বিসিক নগরীতে বিএনপির সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেনের মালিকানাধীন ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় গত ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে ওই কারখানার বিশাল ভবনের অধিকাংশই ধসে পড়ে বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে ইতোপূর্বে ৩৬ জন মারা গেছে এবং নিখোঁজ রয়েছে ১১ জন। নিখোঁজদের সন্ধানে ওই ঘটনার ১৭তম দিনে সোমবার সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যৌথভাবে ‘ফায়ার ফাইটিং এ্যান্ড রেস্কিউ অপারেশন’ চালায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড গত ১২ সেপ্টেম্বর হতে এ অভিযানে অংশ নিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। উদ্ধার অভিযান চলাকালে ধসে পড়া কারখানার ভবনের নিচতলায় মেশিনের পাশ থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুইজনের এবং দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অপর একজনের মানব কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদেহগুলো গলে যাওয়ায় এবং আগুনে ও কেমিক্যালে পুড়ে যাওয়ায় তা নারী না পুরুষের তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিচয়পত্র, ব্যাংকের এটিএম কার্র্ড, চাবির গোছা, মাথার খুলিতে আটকে থাকা দাঁড়িসহ বিভিন্ন আলামত থেকে ওই তিনজনের পরিচয় প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে। ফলে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও নিখোঁজের তালিকায় ১১ জনের নাম রয়েছে। তবে সোমবার উদ্ধারকৃত এ তিনজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর না করে পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ তিনজনসহ অজ্ঞাত ১০ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের মৃতদেহ এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সংরক্ষণ করা রয়েছে। জেলা প্রশাসনের বক্তব্য ॥ গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদ হাসান জানান, টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে সোমবার পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে সোমবার তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন উদ্ধার কর্মীরা। এ তিনজনসহ নিহতদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাকি ২৯ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের লাশ ইতোমধ্যে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়াও নিখোঁজের তালিকায় ১১ জনের নাম রয়েছে। নিহত ওই ১০ অজ্ঞাতদের নাম নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে কি-না এবং সর্বশেষ নিখোঁজের সংখ্যা কমেছে কি-না, তা যাচাই করা হচ্ছে। নিখোঁজদের সংখ্যা নিশ্চিত হতে ইতোমধ্যেই তাদের স্বজনদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। যদি ঘটনার পর বাড়ি ফিরে যাওয়ার কারণে নিখোঁজের তালিকা কমে ১০ জন হয়, তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যাবে নিখোঁজ ১০ জনের তালিকায় হাসপাতালে অজ্ঞাত হিসেবে সংরক্ষিত ওই ১০ মৃতের নাম রয়েছে। তবে একজন নিখোঁজ থাকা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে। ট্যাম্পাকো মালিকের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ ॥ টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় কারখানার মালিকের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ওই হিসাব থেকে হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া যাবে বলে জানিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে অগ্নিকা-ের ঘটনায় হতাহতদের কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। সোমবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ড. শরিফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার তানিম হোসাইন শাওন। অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে আরও ৪ জনের রেফারেন্স ডিএনএ সংগ্রহ ॥ টঙ্গী থানার এসআই ও ট্যাম্পাকো দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুমন ভক্ত জানান, ওই দুর্ঘটনায় সোমবার পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে নিহত ১০ জনের পরিচয় সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়াও ওই ঘটনায় নিখোঁজ ১১ জনের নাম জেলা প্রশাসনের তালিকায় রয়েছে। অজ্ঞাতদের লাশ শনাক্ত করতে গত বুধবার বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকার মালিবাগে সিআইডি ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবে কারখানার নিখোঁজ শ্রমিক জয়নুল আবেদিনের (৩৮), অপারেটর রেদোয়ান আহম্মদ (৩৭), কারখানার স্কুটিং অপারেটর মোঃ আনিসুর রহমান (৩০), সহকারী অপারেটর মোঃ জহিরুল ইসলাম (৩৮), অপারেটর রিয়াজ হোসেন মুরাদ (২২), আজিম উদ্দিন (৩৫), নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী (৩৫), মাসুম আহমেদ (৩০), রফিকুল ইসলামের (৩০) প্রত্যেক পরিবারের দু’জন করে মোট ১৮ জন স্বজন তাদের রেফারেন্স ডিএনএ (লালা ও রক্ত) দিয়েছেন। অবশিষ্ট নিখোঁজ ওই কারখানার ক্লিনার মোঃ মামুন (২৮) ও চুন্নু মোল্লার (২২) চার স্বজন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সোমবার নমুনা দিয়েছেন। নিখোঁজ এ দু’জনের বাবা ও মা’র কাছ থেকে রেফারেন্স ডিএনএ সংগ্রহ করেন চীফ ডিএনএ এনালিস্ট আহম্মদ ফেরদৌস। এ সময় টঙ্গী থানার এসআই সুমন ভক্তসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ও সহযোগিতা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরও জানান, সোমবার উদ্ধারকৃত মৃতদেহের কঙ্কাল তিনটি চুন্নু মোল্লা, নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী ও আনিসুর রহমানের বলে তাদের স্বজনরা প্রাপ্ত আলামত থেকে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে সোমবার উদ্ধারকৃত এ তিনজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর না করে পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ট্যাম্পাকোর ঘটনায় এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি ॥ কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় কারখানার মালিক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হেসেনকে প্রধান আসামি করে টঙ্গী মডেল থানায় এ পর্যন্ত দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর কারখানার মালিকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি দায়ের করেন নিহত শ্রমিক জুয়েলের পিতা আব্দুল কাদের। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে টঙ্গী মডেল থানার এসআই অজয় কুমার বাদী হয়ে কারখানা মালিকসহ ১০ জনকে আসামি করে দ্বিতীয় মামলাটি করেন। উভয় মামলায় মালিকের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়েছে। দুটি মামলা দায়ের হলেও সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। প্রসঙ্গত, টঙ্গীর বিসিক নগরীতে বিএনপির সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেনের মালিকানাধীন ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় গত ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে ওই কারখানার বিশাল ভবনের অধিকাংশই ধসে পড়ে বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে এ পর্যন্ত ৩৬ জন মারা গেছে এবং নিখোঁজ রয়েছে ১১ জন। পরিচয় শনাক্তের পর ২৯ জনের লাশ তাদের স্বজনরা দাফনের জন্য নিয়ে গেছেন। নিহতদের মধ্যে ৭ জনের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ টেস্টের জন্য ইতোমধ্যে নিখোঁজ ১১ জনের মধ্যে ৯ জনের দু’জন করে মোট ১৮ স্বজনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নিখোঁজদের সন্ধানে গত ১২ সেপ্টেম্বর হতে উদ্ধার অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা। শনিবারও নিখোঁজদের সন্ধানে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের যৌথ ‘ফায়ার ফাইটিং এ্যান্ড রেস্কিউ অপারেশন’ চালিয়েছে। তবে এদিন ধ্বংসস্তূপ থেকে এক মানব কঙ্কাল উদ্ধার করেন উদ্ধার কর্মীরা। ইতোমধ্যে হতাহত ও নিখোঁজদের পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়েছে।
×