ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে ;###;জড়িত শিক্ষকরাও;###;তদন্ত রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের

২১ শিক্ষালয়ে জঙ্গী

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

২১ শিক্ষালয়ে জঙ্গী

বিভাষ বাড়ৈ ॥ এক শ্রেণীর উগ্রবাদী ছাত্র-শিক্ষকের মাধ্যমে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে দেশের ২১ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে! যেখানে জঙ্গীবাদী ও ছাত্র-শিক্ষকরা টার্গেট করে ছাত্রদের বিভিন্ন ধরনের জঙ্গীবাদী ওয়েবসাইট, ভিডিও ফুটেজ, জিহাদী বই, জিহাদী বক্তব্য সংবলিত অডিওর মাধ্যমে সরাসরি জঙ্গী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করছে। ‘জঙ্গী মতাদর্শে র‌্যাডিক্যালাইজেশন ঘটছে’-এমন উদ্বেগজনক মতামত তুলে ধরে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দফতরে পাঠানো প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে চলে এসেছে ২১ অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম। যে তালিকায় আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট থেকে শুরু করে অনেক নামী দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজ। আছে জামায়াতের সরাসরি পরিচালিত মসজিদ ও মাদ্রাসা। জানা গেছে, দেশে জঙ্গী হামলা, হত্যা, বিশেষত গুলশানের হলি আর্টিজানের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানের আলোকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যে যে মন্ত্রণালয়ের অধীন তাদের কাছে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। অবিলম্বে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ওপর নজরদারি বৃদ্ধিসহ কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের একটি কপি দৈনিক জনকণ্ঠের হাতে এসেছে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘জঙ্গী মতাদর্শে র‌্যাডিক্যালাইজেশন ঘটছে ঢাকা মহানগরীর এমন কতিপয় মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা ও সুপারিশ’। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইতোমধ্যেই নড়েচড়ে বসেছে সরকারের বিভিন্ন দফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই তার অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন অনুসারে কার্যক্রম পদক্ষেপ নিতে চিঠি পাঠিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রতিবেদনের বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা ইতোমধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে নিয়ে জঙ্গীবিরোধী সমাবেশ, আলোচনাসহ নানা কর্মসূচী করে চলেছি। বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে যাতে সকলে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা এমনিতেই জঙ্গীবিরোধী নানা কাজ করছি। তার পরেও প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে সেখানে বিশেষভাবে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এর বাইরেও কাজ করা হবে। কারণ এর বাইরেও বহু প্রতিষ্ঠানে উগ্রবাদী কর্মকা- হচ্ছে। তবে সরকারের কঠোর অবস্থান ও জনগণের ঐক্যবন্ধ অবস্থানের কারণে আমরা দেশকে উগ্র জঙ্গীমুক্ত করার পথেই আছি। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে পাঠানো গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন উগ্র ধর্মীয় জঙ্গী সংগঠন কর্তৃক ইতোপূর্বে সংঘটিত নাশকতার ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, মাদ্রাসা পড়ুয়া যুবকদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। তবে সম্প্রতি কয়েকটি জঙ্গী তৎপরতায় নামী-দামী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত যুবকদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক শ্রেণীর উগ্রবাদী ছাত্র-শিক্ষকগণ টার্গেট করে ছাত্রদের বিভিন্ন ধরনের ওয়েবসাইট, ভিডিও ফুটেজ, জিহাদী বই, জিহাদী বক্তব্য সংবলিত অডিও এর মাধ্যমে জঙ্গী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করছে বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে।‘ প্রতিবেদনে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘যেসকল মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুবক/ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জঙ্গী র‌্যাডিক্যালাইজেশনের তথ্য পাওয়া গেছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (কমার্স ফ্যাকাল্টি), আগা খান স্কুল (উত্তরা), স্কলাসটিকা ইংলিশ মিডিয়াস স্কুল, লেকহেড গ্রামার স্কুল (ধানম-ি, বনানী ও মোহাম্মদপুর), তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা (মীর হাজিরবাগ, যাত্রাবাড়ী), মসজিদুল মোমেন জামে মসজিদ (মিরপুর-১০)। তালিকায় আরও আছে- দারুল উলুম রহমানিয়া মাদ্রাসা (নিউমার্কেট), আল আমিন মসজিদ (মোহাম্মদপুর), আহলে হাদিস মসজিদ (কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর), জামিয়া নুরিয়া মাদ্রাসা (ডেমরা), লালবাগ জামিয়া কোরানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা, বসুন্ধরা মসজিদ-মাদ্রাসা (বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা), ঢাকা, মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা-মসজিদ কমপ্লেক্স (বসিলা রোড, মোহাম্মদপুর), কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসা, জামেয়া মোহাম্মাদিয়া মাদ্রাসা (সাড়ে এগারো, মিরপুর) এবং তামিরুলল মিল্লাত মাদ্রাসা (টঙ্গী)। প্রতিবেদনে পাঁচ দফা সুপারিশও করা হয়। সুপারিশ করে বলা হয়, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা ও মসজিদে নিরীক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকদের জঙ্গীবিরোধী আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকলকে সচেতন করা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র-ছাত্রী যৌক্তিক কারণ ছাড়া ১৫ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তাদের সম্পর্কে নিকটবর্তী থানা ও গোয়েন্দা সংস্থার নিকট নিয়মিত রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করা। উঠতি বয়সী যুবক নিখোঁজ সংক্রান্তে থানায় জিডি হলে তা অনুসন্ধানপূর্বক নিখোঁজের ছবি, মোবাইল নম্বর ও প্রয়োজনীয় তথ্যসহ গোয়েন্দা সংস্থাকে অবহিত করা এবং ভাড়াটিয়াদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়ে ভাড়া প্রদানে বাড়ির মালিকদের সতর্ক করা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারী বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স ফ্যাকাল্টিতে জঙ্গীবাদীদের কর্মকা- নিয়ে অভিযোগ সামনে এসেছে বহুবার। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ ছাত্রকে প্রায় এক বছর আগে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কৃত ছাত্রদের সঙ্গে ছিল কমার্স ফ্যাকাল্টির জঙ্গীবাদীদের সম্পর্ক। একই অনুষদের শিক্ষক মহিউদ্দিন ও গোলাম মাওলা সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। হিযবুত তাহরীর প্রধান সমন্বয়ক এই মহিউদ্দীন আহমেদ ২০১০ সালে গ্রেফতার হন। পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান বলে পুলিশের দাবি। তবে মহিউদ্দীন আহমেদ জামিনে মুক্ত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত বেতনও পাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর সরকার হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে মহিউদ্দীনকে আর কর্মস্থলে দেখা যায়নি। তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন তাও জানেন না এ বিভাগের কেউই। হিযবুত তাহরীর অন্য এক নেতা ও উপদেষ্টা ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলাকে ২০১০ সালের ৮ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশ এলিফ্যান্ট রোড থেকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হলেও তিনি এখন জামিনে রয়েছেন। জামিনে মুক্তির পর থেকে তিনি তার নিজ কর্মস্থলে কর্মরত রয়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এদিকে জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের দায়ে আটক হলেও এখন জামিনে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ছাত্রের মধ্যে নুরে আলম মোঃ শিহাব উদ্দিন ও সাঈদী হাসান সজীব দুজনেই ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্র। নাকিব ফারহান, আলমগীর হোসেন এবং তারিকুল ইসলাম এ্যাকাউন্টিং এ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের বিভিন্ন বর্ষে ছাত্র ছিলেন। এদিকে বিভিন্ন সময় বহিষ্কার হওয়া উগ্রবাদী এসব ছাত্রের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলেও তাদের সঠিক হদিস মেলেনি। তারা এখন আসলে কোথায়? তারা কি করে? এসব বিষয়ে তাদের পরিবারও কোন বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্র নুরে আলম মোঃ শিহাব উদ্দিনের স্থায়ী ঠিকানা জামালাপুরে। শিহাবের বাবা তোজাম্মেল হোসেন জানান, বর্তমানে শিহাব তার বড় বোনের বাসা ঢাকার হাজারীবাগে থাকেন। তিনি এখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শ্রেণীতে পড়ছেন। কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন জানতে চাইলে তিনি তা জানেন না বলে জানিয়েছেন শিহাবের বাবা। শিহাবের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তোজাম্মেল হোসেন তার মেয়ে শিল্পীর ফোন নম্বর দেন। কিন্তু ওই মোবাইল ফোনে কল করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে শিহাবের বাবা তার মেয়ে শিল্পীর বাড়ির ঠিকানাও দিতে পারেননি। শিহাবের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর নেই জানিয়ে বাবা তোজাম্মেল হোসেন আরও জানান, মোবাইলে ছেলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না হলেও মেয়ের মোবাইলের মাধ্যমে শিহাবের সঙ্গে কথা বলেন। ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আরেক ছাত্র সাঈদ হাসান সজীবের স্থায়ী ঠিকানা টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু কোথায় গিয়েছেন সেটাও কেউ জানেন না। প্রতিবেশীরা বলেছেন, তারা অনেকদিন ধরেই গ্রামে আসেন না। শুধু ঈদের সময় সজীবের বাবা আসত। এখন তাও আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সজীবের কোন সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে পার্শ¦বর্তী এক চা-মুদি দোকানি বলেন, কিছুদিন আগে শুনেছিলাম হিজবুত তাহরীর সংগঠনের সঙ্গে কাজ করে বলে পুলিশ ধরেছিল। সজীবের চাচাত ভাই বাদল বলেন, সজীবদের পরিবারের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। তারা এখন কোথায় থাকেন তাও জানেন না। সজীব কোন একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে তিনি শুনেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকাউন্টিং এ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন নাকিব ফারহান। স্থায়ী বহিষ্কার হওয়ার পর তাকে আর হলে দেখা যায়নি বলে জানায় সূর্য সেন হল কর্তৃপক্ষ। নাকিবের স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামের ঘাট ফরহাদবেগের কাজেম আলী রোডের গুলিস্তান হাইটস। স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত প্রায় ৬ মাস আগে তারা কোন এক অজানা কারণে ওই বাড়ি থেকে চলে গেছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাকিবের পরিবার মূলত পাকিস্তানী। ওই ভবনের যারা থাকেন তারা সবাই পাকিস্তানী বলে জানা গেছে। এ্যাকাউন্টিং এ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের বহিষ্কৃত ছাত্র তারিকুল ইসলামের বাড়ি রাজধানীর খিলগাঁও। খোঁজ নিতে গিয়েও তাদের কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেছেন, কোন ফ্যাকাল্টিতে যদি কোন শিক্ষক বা কেউ জঙ্গীবাদী কর্মকা- করে বলে প্রমাণ মেলে তবে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারের প্রতিবেদনে যদি কোন তথ্য আসে সেভাবে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নেব। কোনভাবেই জঙ্গীবাদী কর্মকা-কে গ্রাহ্য করা হবে না। এখানে নমনীয়তার কোন সুযোগ নেই। জামায়াত-হিযবুত তাহরীরসহ জঙ্গীবাদীদের কর্মকা-ের কারণে সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে বুয়েট। এখানে অবস্থা এমন যে, সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনেই বেরিয়ে আসেÑ প্রতিষ্ঠানটির মাত্র ২২ ভাগ শিক্ষক বর্তমান প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহরীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৮ ভাগ শিক্ষক মোটামুুটি নিরপেক্ষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন, বুয়েট প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতীকরণের কারণেই বুয়েটের এ দুরবস্থা। বুয়েট জামায়াত-শিবিরের তোষণ এবং লালন-পালনের আখড়া হিসেবে পরিচিতÑ এটা তাদের ব্যথিত করে। এ বিষয়ে সরকারের সকল সংস্থার বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন বলে দাবি প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বুয়েটে জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের আস্তানা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা তথ্য প্রকাশ হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় হরতালে নাশকতা চালাতে গিয়ে আটকও হয়েছেন একাধিক বুয়েটের ছাত্র। কয়েক শিক্ষকের সঙ্গে শিবির ও হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের চাঁদা দেয়া ও ই-মেল, ফেসবুকে যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বুয়েটেই উগ্রবাদীরা হত্যা করেছে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী মেধাবী ছাত্র দ্বীপকে। বুয়েটের আরেক প্রগতিশীল সংগঠক তন্ময় আহমেদকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানেরই উগ্রপন্থী শিক্ষক নেতা হাফিজুর রহমান রানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়ে হাফিজুর রহমান রানা স্ট্যাটাসে লিখেছিলেনÑ ‘হায়েনা ওই হায়েনা তুই দেশকে খেয়েছিস, এখন তুই বুয়েট কে খাবি... পারবি না... আমরা বুয়েটের শিক্ষকরা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছি শিকারি। প্রথমে তোর মাথাতে গুলি করব, তারপর তোর পেটে। তারপর তোর মাথা কেটে বুয়েটের গেটের সামনে টানিয়ে রাখব। যাতে আর কোন হায়েনার আক্রমণে বুয়েট আক্রান্ত না হয়।’ জামায়াত-শিবিরের তা-ব চালানোর সময় রাজধানীতে আটক শিবির ক্যাডার বুয়েট ছাত্র শফিকুল ইসলামের কম্পিউটার, ফেসবুক, ই-মেলসহ কাগজপত্রই প্রমাণ করে দিয়েছিল বুয়েটে জামায়াত-শিবির গড়ে তুলেছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। যেখানে একসঙ্গে কাজ করছে হিযবুত তাহরীর। নিজেদের চেহারা লুকিয়ে ‘সাধারণ শিক্ষক’ বলে দাবি করলেও শিবির ক্যাডারসহ পুরো শিবিরের সঙ্গে অন্তত চারজন শিক্ষকের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে আগেই। যারা শিবিরকে অর্থনৈতিক যোগানসহ সকল কাজে উপদেষ্টার মতো কাজ করছেন। যেসব শিক্ষক শিবির ক্যাডারদের সঙ্গে ই-মেল ও ফেসবুকের মাধ্যমে মিলিত হয়ে বছর দুয়েক আগে শিক্ষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অথচ বলেছিলেনÑ ‘এই আন্দোলন মৌলবাদীদের নয়।’ তাদের বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে সেদিন সুশীল সমাজেরও অনেকে উগ্রবাদী এসব শিক্ষক-ছাত্রদের আওয়ামী লীদের অবিচল সমর্থক মনে করেছিলেন। এখন প্রতিবেদনে নাম আসার বিষয়ে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেছেনÑ এখনও কোন চিঠি বা প্রতিবেদন তারা হাতে পাননি। যদি পান তবে অবশ্যই সে অনুসারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। তালিকায় আসা জামায়াতের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান মানারাত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রগতিশীল বাংলাদেশের জন্য মাথা ব্যথার কারণ। সম্প্রতি জঙ্গী সন্দেহে আটক হয় তিন ছাত্রী। যারা ইতোমধ্যেই তাদের অপকর্ম স্বীকার করেছে। গ্রেফতার হওয়া তিন ছাত্রীকে ‘আমাদের ছাত্রী’ স্বীকার করে বহিষ্কারও করেছে মানারাত কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক হচ্ছেন ফার্মেসি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. নুরুন্নাহার রহমান। জঙ্গী তিন ছাত্রী ফার্মেসি বিভাগেরই ছাত্রী। আটক তিন জঙ্গীবাদী হচ্ছেÑ আকলিমা রহমান মনি, খাদিজা পারভীন মেঘনা ও ইসরাত জাহান। মানারাত ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত হয় মানারাত স্কুল, কলেজ ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়টি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে বেরিয়ে আসা জামায়াতের ১২৭ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে মানারাত ইউনিভার্সিটির নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জামায়াতের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করে তাতেও আছে এ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। জামায়াতের এ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধারদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্তরা প্রকাশ্য। বহুবার জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচীতে দেখা গেছে এর কর্ণধারদের। এর চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির অন্যতম পরামর্শক সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। অন্যতম সদস্য হিসেবে আছেন ইসলামী ব্যংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইবনেসিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামায়াত নেতা এএনএমএ জাহের, বর্তমান উপাচার্য ড. চৌধুরী মাহমুদ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একই রাজনীতি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য বিএনপিপন্থী শিক্ষক নেতা অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী অবশ্য দাবি করেছেনÑ তাদের প্রতিষ্ঠানে জঙ্গী মতাদর্শে র‌্যাডিকালাইজেশন ঘটছে না। এর কোন সুযোগ নেই বলেও দাবি তার। তালিকায় আছে জামায়াতের আরেক প্রতিষ্ঠান তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার সকল শাখা। এ প্রতিষ্ঠানকে অনেক জামায়াত-শিবিরের গলাকাটা ক্যাডার তৈরির আস্তানা বলে চেনেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতেও আছে অনিয়ম। যার পরিচালনায় আছে জামায়াতের অন্যতম নেতা জয়নুল আবেদিন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও আছে তালিকায়। জানা গেছে, হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এক সময় যোগাযোগ গড়ে ওঠেছিল বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও এ্যাকশন এইডের পলিসি এনালিস্ট শেখ তৌফিকের সঙ্গে। পরবর্তীতে শেখ তৌফিক ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার হাত ধরেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হয়। পরবর্তীতে ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যা, গুলশানে হলি আর্টিজানে ও শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতসহ অনেক হামলা এবং হত্যাকা- ছাড়াও বিদেশে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ পায়। এরপর থেকেই জঙ্গী কর্মকা-ের কারণে ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জঙ্গীবাদে জাড়িয়ে পড়ার ঘটনার বিষয়ে বলছেন, জঙ্গীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে। তারা কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় উন্মাদনার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে জঙ্গীবাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য চিহ্নিত কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নজরদারি করা ছাড়াও দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণা চালানোসহ নানান পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও নেয়া হচ্ছে কার্যকর পদক্ষেপ। জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ কর্মসূচী থাকবে। একই সঙ্গে সব অভিভাবককে সন্তানদের চালচলনের ওপর খেয়াল রাখতে হবে যেন কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তার সন্তান জড়িত হয়ে না যায়।
×