ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ শাহ্রিনা মিয়ানুর ও ;###;ডাঃ ওয়াহিদ নবি

সন্ত্রাসবাদের গবেষণা এবং একটি পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সন্ত্রাসবাদের গবেষণা এবং একটি পর্যালোচনা

অনেক পেশার বিজ্ঞজনরা সন্ত্রাসবাদ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন, প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সেগুলো মূল্যবান, তবে নিজস্ব মতামতও সেখানে প্রতিফলিত হয়। বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা করা সমস্যাসঙ্কুল। এর একটি সমস্যা হচ্ছে সংজ্ঞা। ব্রায়ান হুইটাকার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। সংজ্ঞা নিয়ে প্রচুর আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে। হুইটাকার লিখেছেন, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করেছে। তিন খ- বই লেখা হয়েছে, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮৬৬। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট উপসংহারে তাঁরা পৌঁছাতে পারেননি। তিনি লিখেছিলেন যে, সংজ্ঞার সমস্যার জন্য দুই হাজার সালে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে মাত্র ১৬টি সন্ত্রাসবাদের ঘটনা ঘটেছিল। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের সংজ্ঞা বহুল ব্যবহৃত, “পূর্বপরিকল্পিত, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, যা বিবাদে জড়িত নয় এমন মানুষের ওপরে চালানো হয়। এটা করে স্বদেশের একটি গুপ্ত সংগঠনের সদস্যরা এবং করা হয় নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীকে প্রভাবান্বিত করার জন্য। আমেরিকানদের ভাষ্য অনুযায়ী ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ’ হচ্ছে ‘যেখানে একটির বেশি দেশের নাগরিক বা একটির বেশি দেশের ভূমি জড়িত থাকে।” সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে, পেশাদার সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করা হলে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বলে মনে করা হয় না। আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে- নমুনা সংগ্রহ করা। যাদের সম্বন্ধে গবেষণা করা হয় তাদের বলা হয়ে থাকে পপুলেশন (ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ)। সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে গবেষণায় সন্ত্রাসবাদীরা পপুলেশন। এদের মধ্য থেকে নমুনা সংগ্রহ করা উচিত এমনভাবে যেন প্রত্যেকের সম্ভাবনা থাকে নমুনার অন্তর্গত হওয়ার। সন্ত্রাসবাদীরা বিভিন্ন উৎস থেকে আসে। তাদের সবাই ধরা পড়ে না। ধরা পড়লেও আলোচনার সময় দলের স্বার্থে তারা গোপনীয়তা পালন করে। এসব ও অন্য কারণে এ বিষয়ে গবেষণা করা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু এসব সমস্যা সত্ত্বেও পণ্ডিতগণ মনে করেন সন্ত্রাসবাদ সম্বন্ধে যত মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক, সামাজিক ও বিশ্লেষণমূলক তথ্য জানা গেছে তাতে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা সহজ হবে। দেশ আর কাল অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদের প্রকৃতি ভিন্ন রকমের হয়। রেক্স হাডসনের মতে, আগে সন্ত্রাসবাদীরা এমন সব অস্ত্র ব্যবহার করত না যা দিয়ে অনেক লোক মারা যেতে পারে। এসব অস্ত্রকে তিনি ডব্লিউ, এমডি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে সন্ত্রাসবাদীদের ধারণা ছিল যে, বেশি লোক মারা গেলে জনমত সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে যাবে এবং এর ফলে তাদের উদ্দেশ্য ভ-ুল হবে। নব্বইয়ের দশক থেকে সিফ ব্যবহৃত হতে থাকে। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ এই সময় থেকে শুরু হয়। এই সময়ের সন্ত্রাসবাদের আর একটি বিশেষত্ব বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, যেমন রসায়নবিদ, জীববিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, পদার্থবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি। বিভিন্ন রকমের পটভূমিকায় সন্ত্রাসবাদীদের সম্বন্ধে জনসাধারণের ধারণা ভিন্ন রকমের হয়। ক্ষুদিরাম সমস্ত ভারতবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র। ভগত সিং ও সূর্য সেনও তাই। বিদ্রোহী কবি তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ বইটি উৎসর্গ করেন যুগান্তর দলের নেতা বারীন্দ্র কুমার ঘোষকে। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেন, ‘ভাঙ্গা বাংলার রাঙ্গা যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর।’ কিন্তু জনগণের শ্রদ্ধা ও সমর্থন সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদ সীমিত হয়ে পড়ে। সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে, তিনি ভগত সিংকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সন্ত্রাসবাদ আস্তে আস্তে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ কি পরিহার করা উচিত নয়? উত্তরে ভগত সিং বলেছিলেন যে, কথাটির সঙ্গে তিনি একমত। কিন্তু পাঞ্জাব ঘুমুচ্ছে। পাঞ্জাবের ঘুম ভাঙ্গার জন্য তিনি বোমা ফাটাতে চান। তাঁর কথা মনে রাখার মতো। সূর্য সেন ও তাঁর দলবল অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। সা’দত আলি আখন্দ লিখেছেন যে, সূর্য সেনের দলের পরাজয় ঘটলে সরকারী নির্যাতন নেমে এলে একশ্রেণীর লোক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করার চেষ্টা করে। বাস্তব কারণে ভারতের সন্ত্রাসবাদীরা সন্ত্রাসবাদ পরিহার করে বিপ্লবের পথ অবলম্বন করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ সন্ত্রাসবাদী দলগুলোকে বিভিন্ন চরিত্রের বলে মনে করেন। উদাহরণ জাতীয়তাবাদী- বিচ্ছিন্নতাবাদী যেমন আইআরএ। ধর্মীয় যেমন আল কায়েদা। আধুনিক ধর্মীয় যেমন আইএস। সামাজিক বিপ্লবী যেমন নকশালপন্থী। সন্ত্রাসবাদী দলগুলোকে এভাবে ভাগ করার পেছনে যুক্তি আছে। আইআরএ এবং পিএলও দুটি ভিন্ন দেশের দল হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সাদৃশ্য আছে। আউম সিনরি কিও এবং আল কায়েদার মধ্যে বেশ সাদৃশ্য আছে। কারণ দল দুটি ভিন্ন দেশের হওয়া সত্ত্বেও তারা ধর্মীয়। এছাড়া সন্ত্রাসবাদী দলগুলোকে ও সন্ত্রাসবাদীদের অন্যভাবেও বর্ণনা করা যায়। এমাদ সালিব আত্মহত্যাকারী সন্ত্রাসবাদীদের সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে সন্ত্রাসবাদী হত্যা ও সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। তিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের স্যামসনের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ৩ হাজার মানুষ হত্যা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও মারা গেছেন। সালিব দলীয় নেতার প্রতি অনুসারীদের আনুগত্যের কথা উল্লেখ করেছেন। নেতার প্রভাবে অনুসারীরা অমরত্ব লাভের শিক্ষা লাভ করে। বেহশ্তবাসী হওয়ার দীক্ষা লাভ করে। যেখানে একটি ছোট দল হত্যা ও আত্মহত্যায় লিপ্ত হয় সেই অবস্থাকে তিনি ফলিয়া প্লুজিয়ার্স বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ দলের সবাই এক রকমের বিশ্বাস করত। এমিলি কর্নার, পল গিল ও অলিভার মেসন আলোচনা করেছেন দলভুক্ত সন্ত্রাসবাদী ও নির্দলীয় সন্ত্রাসবাদীদের সম্বন্ধে। যেসব সন্ত্রাসবাদী একা একাই সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হয় তাদের মধ্যে মানসিক রোগীর সংখ্যা বেশি। সন্ত্রাসবাদী দলে শিক্ষা, গোপনতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয় জড়িত আছে। মানসিকভাবে সুস্থ না হলে কেউ দলের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারবে না। কর্নার গবেষণার জটিলতা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার কথা বলেছে যে, সন্ত্রাসীদের মানসিক রোগ আছে বা নেই এই ধরনের বিপরীতমুখী ধারণা পোষণ করা উচিত নয়। বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়, যেমনÑ আর্থিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি। এমনকি কেউ কেউ মনে করেন যে, সন্ত্রাসবাদীদের দৈহিক কারণেও সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। এটা ঠিক নয় যে, সন্ত্রাসবাদীদের মানসিক গঠনই সন্ত্রাসবাদের একমাত্র কারণ। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিতে পারে। রাসেল ও মিলার মনে করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈপ্লবিক আদর্শ যেমন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের জন্ম হয়েছে। জনসন ও মিলার মনে করেন দেশের নাগরিকীকরণ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সন্ত্রাসবাদকে সাহায্য করতে পারে। জেনকিনস মনে করেন যে, কোন কোন দেশে পল্লী অঞ্চলে ব্যর্থতার জন্য সন্ত্রাসবাদীরা শহরে আশ্রয় নেয়। ক্রেনশ মনে করেন সন্ত্রাসবাদী দলগুলো সমষ্টিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু অনেকে মনে করেন সন্ত্রাসবাদী নয়, গেরিলা দলগুলো সম্বন্ধে ক্রেনশের মন্তব্য সঠিক। হাবার্ড মনে করেন যে, সন্ত্রাসবাদীদের মস্তিষ্কে নর এপিনেফরিন নামে একটি রাসায়নিক দ্রব্য তাদের সন্ত্রাসবাদী করে তোলে। উটস এবং উইগল মনে করেন দৈহিক, মানসিক ও রাজনৈতিক কারণের সমষ্টি সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়। গাটম্যান মনে করেন সন্ত্রাসবাদী কাজে শিকারের চেয়ে দর্শক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উদার দর্শকই লক্ষ্য অর্জনে সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করে। মনস্তত্ত্ববিদরা সন্ত্রাসবাদ সম্বন্ধে গবেষণা করেছেন। সন্ত্রাসবাদের কারণ সম্বন্ধে তাঁদের একটি হাইপোথিসিস বহুল আলোচিত। এটির নাম ‘নৈরাশ্য- আগ্রাসন হাইপোথিসিস।’ রবার্ট গোর এটির প্রবক্তা। তাঁর মতে, উচ্চাশা ও আশাপূর্তির মধ্যে প্রভেদ আগ্রাসনের জন্ম দেয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত নৈরাশ্য সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়। ফ্রাঙ্কো ফারাকুটির মতে সন্ত্রাসবাদীরা একটি বিশেষ সংস্কৃতির সদস্য। নাটসন মনে করেন যে, কিছু অর্জনে ব্যর্থতা একটা নেতিবাচক পরিচিতির জন্ম দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে একজন সন্ত্রাসবাদী পরিচিতি লাভ করতে পারে। আর একটি পরিচিত হাইপোথিসিস হচ্ছে ‘আত্মপ্রেম- ক্রোধ হাইপোথিসিস’। বাল্যকালে যদি নিজের সম্বন্ধে অবাস্তব বড় ধারণা জন্মে এবং বাস্তবতার সম্মুখীন হলেও যদি সে ধারণা চলে না যায় তবে তার মনে অতি উচ্চাকাক্সক্ষার জন্ম নেয়। এই আকাক্সক্ষা সে মিটাতে পারে না। যার ফলে তার মনে ক্রোধের জন্ম হয়। কিন্তু নিজের ব্যর্থতার জন্য সে অন্যকে দায়ী মনে করে। এভাবে সে সন্ত্রাসবাদী দলে যোগ দেয়। সন্ত্রাসবাদীদের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো নিয়ে অনেক গবেষণা করা হয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য হয়েছেন যে, সন্ত্রাসবাদীদের নির্দিষ্ট কোন মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো নেই। নাটসন মনে করেন সন্ত্রাসবাদীরা এজন্য ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হতো যে, তারা বিশ্বাস করত তাদের তথ্য প্রচার করার আর কোন পন্থা সমাজ ব্যবহার করতে দেয় না। নতুন সদস্য বা সদস্যাদের সংগঠনে যোগ দেয়ার প্রক্রিয়া এরিক শ’ বর্ণনা করেছেন ‘পারসোনাল পাথওয়ে’ নামে। বঞ্চনার শিকার এমনি জনগোষ্ঠী থেকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদীরা আসে। প্রথমদিকে তারা উদার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। সমাজের অবস্থার উন্নতি না হলে তাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর হতে থাকে। পরিবার বা বন্ধুদের কারও সাহচর্যে তারা সন্ত্রাসবাদী দলের সঙ্গে পরিচিত হয়। কিন্তু দলের সদস্য হতে আরও সময় লাগে এবং সম্মুখীন হতে হয় বিভিন্ন পরীক্ষার। আদর্শ, বিশ্বাস ইত্যাদি অত্যন্ত জটিল বিষয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিষয়ের সমস্যা অফুরন্ত। এসব এবং অন্যান্য কারণে তাই সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে গবেষণা করা বেশ কঠিন। কিন্তু সবাই চায় সন্ত্রাসবাদীদের মন সম্পর্কে জানতে, যাতে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গবেষকদের চেষ্টায় আমরা আরও বেশি জানব সন্ত্রাসবাদ সম্বন্ধে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে সেটা আমাদের সবাইকে বাস্তববাদী হতে সাহায্য করবে। লেখকদ্বয় : মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ
×