ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘বেপরোয়া’ শাল্লার ইউএনও ॥ ভয়ে এলাকা ছাড়া স্থানীয় সাংবাদিকরা

প্রকাশিত: ০২:৪২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

‘বেপরোয়া’ শাল্লার ইউএনও ॥ ভয়ে এলাকা ছাড়া স্থানীয় সাংবাদিকরা

নিজস্ব সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ ॥ তিনি সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলায় ইউএনও। নাম আসিফ বিন ইকরাম। প্রায় প্রতিদিনই নতুন ঘটনার জন্ম দিয়ে চলছেন তিনি। ‘সাংবাদিক’ শুনলেই ক্ষেপে যান। সারা উপজেলায় এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ‘ইউএনও সাব’। গত তিনদিন ধরে তার ভয়ে এলাকা ছাড়া প্রত্যন্ত জনপদ শাল্লার সাংবাদিকরা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। গত রবিবার স্থানীয় এক সাংবাদিককে পিটিয়েছেন তিনি তার একটি মুদি দোকানে আগুন দিয়েছেন। সোমবার আবারও আরেক সাংবাদিকের একটি দোকান ঘর ভেঙ্গে দিয়েছেন। হুমকি দিয়েছেন যাকে সামনে পাবেন থাকে মোবাইলকোর্টে সাজা দেবেন। ২ বছর আগে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় ইউএনও হিসাবে যোগদান করেন তিনি। এর আগে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইউএনও থাকাকালে একজন পাথর খেকোর কাছ থেকে নিজের স্ত্রী’র ব্যাংক হিসাবে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এই ইউএনও। অবশ্য, এসব অভিযোগের জবাবে আসিফ বিন ইকরাম বলেন,‘আমি অবৈধ সুযোগ সুবিধা দেই না, কাজ করার চেষ্টা করি, আমার বিরুদ্ধে যা বলা হয় সবই মিথ্যা, শাল্লায় এসে আমি অনেক ভাল কাজই করেছি, এগুলোর প্রচার নেই, কেবল নেতিবাচক সংবাদ করা হচ্ছে’। জানা যায়, আসিফ বিন ইকরাম ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় যোগ দিয়েছিলেন। উত্তরা ব্যাংকের কোম্পানীগঞ্জ শাখায় পাথর ব্যবসায়ী আবদুল আলী তাঁর মালিকানাধীন ‘মেসার্স শাহ আনোয়ার আলী স্টোন ক্রাশার’-এর নামে থাকা ব্যাংক হিসাব নম্বর (২৬৩৫৫১২) থেকে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বরে ক্রস চেকের মাধ্যমে ২৫ লাখ টাকা এবং ১৭ ডিসেম্বর পাঁচ লাখ টাকা জমা পড়ে তানিয়া তাবাসসুম নামের এক নারীর ব্যাংক হিসাবে (নম্বর ১১১-৪৮২)। তানিয়া ইউএনও আসিফ বিন ইকরামের স্ত্রী বলে ব্যাংকের ওই শাখার কর্মকর্তারা গণমাধ্যম কর্মীদের নিশ্চিত করেছিলেন। নির্বিঘ্নে বোমা মেশিন চালানোর জন্য এই ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার একটি দৈনিকসহ স্থানীয় অনেক দৈনিকে এই সংবাদ ছাপা হয়েছিল। এরপর আসিফ বিন ইকরামকে ২০১৪ সালের ৩ জুলাই কোম্পানীগঞ্জ থেকে প্রত্যন্ত জনপদ সুনামগঞ্জের শাল্লায় বদলি করা হয়। শাল্লায় যোগদানের পর থেকেই গণমাধ্যম কর্মী দেখলেই তিনি ক্ষেপে উঠেন এবং প্রায়ই বলেন,‘সাংবাদিকদের গুলি করে মারতে হবে’। গত জুলাই মাসে একদিন উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় তিনি বলে ওঠেনে-‘সাংবাদিকদের গুলি করা প্রয়োজন’। সভায় উপস্থিত এক সাংবাদিক ঢালাওভাবে এমন কথা বলার প্রতিবাদ করায় তিনি ঐ সভায়ই দুঃখও প্রকাশ করেন। রবিবার ও আজ সোমবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনের সড়কে তিনি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চালান। এসময় বকুল আহমদ তালুকদার নামের একজন গণমাধ্যম কর্মীর একটি টঙ দোকান (ছোট ভ্রাম্যমাণ দোকান) উচ্ছেদ করেন। অভিযানের এক পর্যায়ে দোকানে থাকা পেট্রোল ঢেলে দোকানে আগুন দেওয়া হয়। ইউএনও আসিফ বিন ইকরাম ঐ সময় নিজেই লাঠি হাতে নিয়ে বলেন,‘কেউ ছবি ওঠাতে পারবে না’। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে এলাকাবাসী এসে আগুন নেভানো শুরু করেন। তিনি আগুন নেভাতে বাধা দিলেও লোকজন তার কথা শুনেননি। সোমবার আবারও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের নামে সাংবাদিক বাদল চন্দ্র দাস এর একটি টঙ দোকান (ছোট ভ্রাম্যমাণ দোকান) ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেন। এসময় দোকান থেকে কোন মালামাল বের করতে দেয়া হয়নি। বকুল আহমদ তালুকদার গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন,‘তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান আবুল লেইছ চৌধুরী’র উপস্থিতিতে বর্তমান ইউএনও আসিফ বিন ইকরাম সাহেবের অনুমতি নিয়ে আমি দোকান দিয়েছিলাম। কোন কিছু না জানিয়েই আজ আমার দোকান ভেঙে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এসময় আমাকে মারধরও করা হয়েছে, আমার কান দিয়ে রক্তকরণ হয়েছে, আমি প্রথমে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় আমাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে’। সাংবাদিক বাদল চন্দ্র দাস বলেন, এই ইউএনও আসার পর থেকে ধারাবহিকভাবে সাধারণ জনগনসহ সাংবাদিকদের নির্যাতন করে চলছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে চলে আরও সীমাহীন নির্যাতন। তার ক্ষমতার অপব্যবহারে আমাদের পিট দেয়ালে ঠেকেছে। বার বার উর্ধতন মহলে জানিয়েও কোন সুরাহা হচ্ছে না। বরং দিন দিন নির্যাতন-নিপিরনের মাত্রা বাড়ছে। এই ইউএনও গত এপ্রিল মাসে কুহিনুর বেগম নামের এক মহিলাকে কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে পিটিয়েছেন। এই মহিলা পরে এই বিষয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সম্প্রতি. উপজেলা পরিষদের প্রায় ৩ লাখ টাকার গাছ কেটে নিজের তত্বাবধানে থাকা পুকুরে কাঁটা হিসাবে ব্যবহারের জন্য ফেলে দেন তিনি। হাওর-বাওরের উপজেলা শাল্লা সদরের একমাত্র পুকুরে ভাসমান সবজী চাষের অনুমতি দিয়ে তিনি পুকুরটি ব্যবহারের অনুপযোগী করেন। গত এক বছরে শাল্লার ‘চোরের গাঁও’ হিসাবে পরিচিত কামারগাঁও গ্রামের পাশে দুই দফায় পুকুর করার নামে তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও ওখানে কোন পুকুর হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর কার্যালয়ে এবং উপজেলা গণমিলনায়তনে প্রায়ই এক সভায় একাধিক ব্যানার টানিয়ে ছবি উঠিয়ে প্রোগ্রাম হয়েছে,দেখিয়ে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেন। অবশ্য. উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ বিন ইকরাম বলেন,‘আজকের ভ্রাম্যমাণ আদালতে ছবি তুলতে আমি কাউকে নিষেধ দেইনি। সরকারি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে ওখানে অবৈধ তেলের ব্যবসা করা হতো। এজন্য উচ্ছেদ করা হয়েছে। কুহিনুর বেগম বিভিন্ন অফিসে গিয়ে ব্ল্যাক মেইল করতেন এবং টাকা চাইতেন। তাই তাকে কারাদন্ড দিয়েছি আমি। উপজেলা পরিষদের গাছ নয়, গাছের ডাল কেটে বিক্রি করে এই টাকা দিয়ে মানুষের ব্যবহারের পুকুর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। চোরেরগাঁও কামারগাঁওয়ে প্রথমে ৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা পুকুর করার জন্য দেওয়া হয়েছিল। পরে আবার কিছু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরা অর্ধেক কাজ করে কাজ শেষ করেনি। আমি এক সভায় একাধিক ব্যানার কখনোই টাঙাইনি। এক সভার পর আরেক সভায় ব্যানার টাঙিয়েছি। তিনি বলেন,‘আমি শাল্লায় অনেক ভাল কাজ করেছি বলেই মাননীয় সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেন মহোদয় বদলি হবার পরও আমাকে আবার এখানে রেখেছেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, এই ইউএনওকে নিয়ে আমি বেকায়দায় আছি। সে একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলছে। আমি একাধিক বার উর্ধতন মহলে তার আচার আচরণ নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছি। তিনি বলেন, সাংবাদিককে মারধরের বিষয়টি কেউ আমাকে জানায়নি। আমি বিষয়টি শুনিনি। তবুও খোঁজ নিয়ে দেখব। ঘটনার সত্যতা পেলে ইউএনও’র বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×