ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আকিল জামান ইনু

ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদানমুক্ত প্রাকৃতিক উপাদানে প্রস্তুত প্রসাধন সামগ্রীর চাহিদা এখন ব্যাপক এবং তা ক্রমাগত বাড়ছে। প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রস্তুত বলে বিজ্ঞাপিত প্রসাধন সামগ্রীর বাজার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘প্রাকৃতিক উপাদানে প্রস্তুত’ এই মোড়ক প্রকৃত অর্থ কিংবা সত্য প্রকাশ করে না। অভিনেত্রী জেসিকা এ্যালবা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রস্তুত বলে প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসায় বিপুল মুনাফা অর্জন করছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ‘দি অনেস্ট কোম্পানি’র বর্তমান বাজারমূল্য বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ইউনিলিভার অনেষ্ট কোম্পানীটি ১৭০ কোটি ডলারে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেশিরভাগ প্রসাধন সামগ্রী উৎপাদক তাদের পণ্য প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রস্তুত বলে বিভিন্ন ভেষজ, গাছপালার ছবি সংবলিত মোড়কে বাজারজাত করছে। ক্রেতারা চাইলে তাদের পক্ষে ভেগান নেল পালিশ, ঠোঁটে গোজি বেরি থেকে উৎপাদিত গ্লস কিংবা খনিজ উপাদান থেকে প্রস্তুত পাউডার ব্যবহার করতে পারেন। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গ্রান্ড ডিউয়ের দেয়া তথ্য মোতাবেক প্রাকৃতিক উপাদাননির্ভর প্রসাধন সামগ্রীর বাজার ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে ২০১৩ সালে। সে বছর উত্তর আমেরিকার রাজস্বের ৩৫% শতাংশ এসেছে এ খাত থেকে। ২০২০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক প্রসাধন সামগ্রীর এ বাজার ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রস্তুত চুলের রং এখন হোল ফুডসের মতো প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করছে ‘নেচারটিস্ট’ ও ‘হার্বাটিস্ট’ নামে নামকরণের ক্ষেত্রে সিভিএস ওয়াল গ্রীন পর্যন্ত প্রাকৃতিক উপাদানের প্রাধান্য বোঝাতে পণ্যের নাম রাখছে। ‘ক্লারিওল নেচারাল ইনসটিং বা ‘শেয়া ময়েশ্চার’ নামে। এই সামগ্রীগুলো উপাদান হিসেবে নারিকেল তেল, ওলিভ অয়েল অথবা শেয়া বাটারকে সামনে আনলেও এই উপাদানগুলো কতটা প্রাকৃতিক গুণমান বজায় রাখতে পারছে তা তর্কসাপেক্ষ ও মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়। উল্লিখিত সামগ্রীগুলোর বাজারজাতকালীন মোড়কে উল্লিখিত উপাদানগুলো কতটা মৌলিক কাঠামোতে বিরাজমান তা খতিয়ে দেখতে রসায়নবিদগণ পণ্যগুলোতে ব্যবহৃত ২৫টি উপাদান পরীক্ষা করেন। তাদের প্রাপ্ত ফলাফল বলছে, বেশিরভাগ উপাদান প্রকৃতি থেকে আহরণ করা হলেও যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পণ্যটি প্রস্তুত হয় তাতে উপাদানগুলোর মৌলিক কাঠামো কতটা বজায় থাকে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। রসায়নবিদ মিশেল ফ্রাঙ্কলের মতে এই পণ্যগুলোর বেশিরভাগের উৎপাদন প্লান্টে এবং তাদের ‘প্রাকৃতিক’ বলাটা সত্যিই কঠিন। এ ছাড়াও এক্রিলেটস কোপলিমার কৃত্রিম উপাদানটি চুলের সঙ্গে রং লেগে থাকতে সাহায্য করে বা ইমালশন স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে কাজ করে। আর্ট রিচ, একজন প্রসাধন রসায়নবিদ বলেন উল্লিখিত উপাদানগুলোর মধ্যে খুব কম উপাদানই চুল রং করার অংশ ত্বক কিংবা চুলের যতেœ প্রস্তুতকৃত বেশিরভাগ সামগ্রীর বেলাতেও তাই। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাজারে প্রচলিত ব্রণ বা মেছতা ক্রিমে অসংখ্য উপাদান থাকলেও কেবল দুটি উপাদান এক্ষেত্রে কাজ করে। যাচাইকৃত চারটি চুলের রঙের প্রতিটিতেই অন্তত একটি কৃত্রিম উপাদান পাওয়া যায় : এটি ডরনিক এ্যাসিড। এটিডরনিক এ্যাসিড বিভিন্ন ক্লিনিং প্রডাক্টে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা তাদের পানিতে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও এটি সাবান ও শ্যাম্পুতেও। ফ্রাঙ্কল বলেন, ‘একজন রসায়নবিদের গুরুত্বপূর্ণ আণবিক গঠন। তিনি আরও বলেন, ‘মৌলগুলোর আণবিক গঠন তাদের কার্য নির্দেশ করে এবং তারা কতটা ক্ষতিকারক তাও নির্ধারণ করে। কারলা সিয়েরভিলড ক্লারিওল রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান গবেষক হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন “‘ন্যাচারাল ইনসটিঙ্কটস’ বাজারে প্রচলিত অন্যান্য চুলের রং থেকে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। এতে প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তেল ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি এ্যামোনিয়া অপসারণ করা হয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড রুট’ নিউইয়র্কে ‘নেচারটিস্ট’ বাজারজাত করণের দায়িত্বে নিয়োজিত। ব্রেন্ডা বয়েস কোম্পানিটির সভাপতি, তার মতে ‘নেচারটিস্ট’-এর ফর্মুলা পুনরায় যাচাই করা জরুরী। এর সব উপাদান ক্যালিফোর্নিয়া বিধি ৬৫ কিংবা ‘হোল ফুডস’-এর মান অনুযায়ী যথাযথ নয়। বিধি ৬৫ অনুযায়ী পণ্যে উপস্থিত কোন উপাদান যদি ক্যান্সারের কারণ হয় অথবা শিশুর জন্মকালীন বা প্রজননকালীন সঙ্কটের কারণ হয় তবে তা মোড়কে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। তার মতে, ‘নেচারটিস্ট শতভাগ প্রাকৃতিক না হলেও বাজারে প্রচলিত অন্যান্য চুলের রঙের ভাল বিকল্প বলে গণ্য হতে পারে। কোন্ সামগ্রী কতটা প্রাকৃতিক তা নির্ণয় সত্যিই দুরূহ। আর এ বিষয়ে এফডিএরও কোন কার্যকর সংজ্ঞা নেই, বিশেষ করে প্রসাধন সামগ্রীর ক্ষেত্রে। কেবল ইউএসডিএ কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে ‘প্রাকৃতিক’ পণ্যসমূহের মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কোন পণ্য ইউএসডিএর ন্যাশনাল অর্গানিক প্রোগ্রামের আওতায় তাদের নিয়োজিত এজেন্টের কাছ থেকে সনদ সংগ্রহ করতে পারে। সনদ সংগ্রহের পর তারা পণ্যটি সহজেই শতভাগ প্রাকৃতিক এই মোড়কে বাজারজাত করে থাকে এবং এতে ৭০% অর্গানিক উপাদান থাকাই যথেষ্ট। ফ্রাঙ্কল এবং কার্লা দুজনেই একমত যে, শতভাগ প্রাকৃতিক উপাদানে চুলের রং তৈরি প্রায় অসম্ভব। চুলে রং ধরানোর জন্য পারঅক্সাইড এবং যে কোন একটি এ্যালকালাইজারের উপস্থিতি একান্ত আবশ্যক। কার্লা আরও বলেন, ‘এ দুটি উপাদানের উপস্থিতি চুলের রঙে অতি প্রয়োজনীয় কিন্তু দুটো উপাদানই প্রাকৃতিক উপাদানের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। ফ্রাঙ্কলের মতে কেউ যদি তার চুল শতভাগ প্রাকৃতিক উপাদানে রাঙাতে চায় তবে তিনি হেনা কিংবা খনিজ পাউডার ব্যবহার করতে পারেন। সত্য হচ্ছে আপনার চুলের রং পরিবর্তন কি রংকরণ এখনও একটি নোংরা রাসায়নিক প্রক্রিয়াই রয়ে গেছে। শুধু চুলের রং নয় যে কোন প্রসাধন সামগ্রী যা শতভাগ প্রাকৃতিক উপাদানে প্রস্তুত বলে মোড়কে আবদ্ধ হয়ে বাজারে আসছে তা আসলে কতটা প্রাকৃতিক এই প্রশ্নটি বড় আকারেই উচ্চারিত হচ্ছে। সবারই জিজ্ঞাসা প্রাকৃতিক প্রসাধনী কতটা প্রাকৃতিক? সুত্রঃ ডেইলি হেরাল্ড
×