ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের বিরোধিতায় ব্যর্থ হলো তাদের চেষ্টা

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে ফের নাক গলাল পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে ফের নাক গলাল পাকিস্তান

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আবারও নাক গলিয়েছে পাকিস্তান। নিউইয়র্কে কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিয়াল এ্যাকশন গ্রুপের (সিমেগ) বৈঠকে এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান অভিযোগ তুললে তা নাকচ হয়ে গেছে। সিমেগের ওই বৈঠকে পাকিস্তানের তোলা প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে ভারত। রবিবার দিল্লীর একটি কূটনৈতিক সূত্র জনকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সিমেগ বৈঠকে পাকিস্তানের এই অবস্থান নেয়ার পরে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সিমেগ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশের যোগদান উপলক্ষে এবার নিউইয়র্কে সিমেগের ৪৯তম বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সিমেগের সদস্য না হওয়ায় ওই বৈঠকে বাংলাদেশের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠকে সাইপ্রাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লোয়ানিস ক্যাসোলিডস সভাপতিত্ব করেন। সেখানে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ। আর ভারতের পক্ষ থেকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (বহুপক্ষীয় ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা) সুজাতা মেহতা। দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র জনকণ্ঠকে জানিয়েছ, সিমেগ বৈঠকে অংশ নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, ১৯৭১ সালের একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ বিচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বেশ কয়েকজন ইসলামী নেতাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিচার করে মৃত্যুদ- দিয়েছে। কমনওয়েলথের সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাসের জন্য উপস্থিত সদস্য দেশগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান। তবে পাকিস্তানের ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ভারত। সিমেগ বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই বিচার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থনও রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীণ একটি বিষয়। তাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব তোলা কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। সে সময় ভারতের এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন বৈঠকের সভাপতি ও সাইপ্রাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লোয়ানিস ক্যাসোলিডস। তিনিও বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সঠিক নয়। একই সঙ্গে সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য রাখেন সলোমন দ্বীপপুঞ্জের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ মিলনার তোজাকা ও জাতিসংঘে নিযুক্ত কেনিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি কোকি মুলি গ্রিগনন। ফলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেখানে কোন নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়নি। সিমেগ বৈঠকে পাকিস্তানের তোলা প্রস্তাবের বিষয়ে ইতোমধ্যেই অবহিত হয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের তোলা প্রস্তাবের খবর জানতে পেরে বাংলাদেশ এখন অনেক ক্ষুব্ধ। কেননা বার বার সতর্ক করার পরেও পাকিস্তান বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নাক গলিয়ে আসছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তো বটেই বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দেশটি নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। সিমেগ বৈঠকের পাকিস্তানের এই পদক্ষেপে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েনের জের ধরে আগামী সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণও অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেননা বার বার পাকিস্তানকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে নাক গলাতে নিষেধ করলেও পাকিস্তান তা শুনছে না। আগামী নবেম্বরে ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের কথা রয়েছে। তার আগেই পাকিস্তান বার বার ঢাকা-ইসলামাবাদের সম্পর্ক তিক্ত করে তুলছে। সে কারণে এই সম্মেলন বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে কিনা সেটা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর আগেও একাধিক সিমেগ বৈঠকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তোলে পাকিস্তান। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত সিমেগের ৪৮তম বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকার হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করে পাকিস্তান। তবে সে সময়ও বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ওই অভিযোগ নাকচ করে দেয়া হয়। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সিমেগ সদস্য না হওয়ার কারণে ওই ফোরামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে সুযোগ নিতে চায় পাকিস্তান। তবে বাংলাদেশের বন্ধু দেশগুলোর কারণে বার বারই পাকিস্তানের সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এবারও সিমেগের বৈঠকে পাকিস্তান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে তা নাকচ হয়ে যায়। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান শুরু থেকেই নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তারা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেমের মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রেক্ষিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অযাচিতভাবে বিবৃতি দেয়। এই বিবৃতির জের ধরে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করা হয়। পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়া হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা কোনভাবেই যেন নাক না গলায়। তবে দেশটিকে কড়া প্রতিবাদ জানালেও পাকিস্তান তাদের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাস করে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে দেশটির তৎকালীন ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে বাংলাদেশ। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। এরপর মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘিরে দেশটি আবারও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। এখন নিউইয়র্কে সিমেগ বৈঠকে পাকিস্তানের তোলা প্রস্তাব নিয়ে আবারও দুই দেশের মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হলো।
×