ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, কেউ স্বাস্থ্যসেবা দানকারীর প্রতি সহিংস আচরণ করলে জামিন অযোগ্য অপরাধ ;###;বলে গণ্য হবে

ডাক্তারের ভুল হলে পুলিশের রিপোর্ট ছাড়া গ্রেফতার নয় ॥ ৩ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি রোগী ও স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা আইন

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ডাক্তারের ভুল হলে পুলিশের রিপোর্ট  ছাড়া গ্রেফতার নয় ॥ ৩ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি রোগী ও স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা  আইন

নিখিল মানখিন ॥ তিন বছর ধরে ঝুলে আছে ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন’। ২০১৪ সালে একটি খসড়া তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৬ সালে ওই খসড়া আইনে সংযোজন-বিয়োজন ঘটে। আর নামকরণ করা হয়েছে ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন- ২০১৬’। প্রতিবেশী দেশসমূহে এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা করে অধিকতর সমৃদ্ধ খসড়া প্রণয়নের জন্য একটি কমিটিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। কমিটি খসড়া আইনটি নিবিড় পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সমৃদ্ধ খসড়া প্রণয়ন করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অর্থাৎ ২০১৭ সালের আগে আইনটি চূড়ান্ত রূপ পাচ্ছে না। নতুন প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, রোগীর প্রতি অবহেলা বা চিকিৎসায় ভুল হলে চিকিৎসক বা সেবাদানকারীদের কাউকেই প্রথমে গ্রেফতার করা যাবে না। পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলে পরেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এ আইন লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর কোন ব্যক্তি স্বাস্থ্যসেবাদানকারীর প্রতি সহিংস আচরণ করলে, প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর চালালে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে বলে গণ্য হবে। গত ২০১৪ সালের খসড়া আইনের তুলনায় নতুন আইনে সেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দ-ের মাত্রা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট বাড়ছে। গত জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলামের ভাইয়ের মেয়ে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে মারা যান। এ ঘটনায় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রতিবাদে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখা বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতালে ধর্মঘট পালন করে। এতে আস্থার সঙ্কটের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুলের অভিযোগ তুলে চিকিৎসক ও অন্যদের ওপর হামলা এবং তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হচ্ছে। এতে চিকিৎসাকর্মীরা স্বাভাবিক পরিবেশে কাজ করতে পারছেন না। পাশাপাশি রোগী যেন কোন ধরনের হয়রানি, অবহেলা বা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্যও আইনটির দরকার। চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ খতিয়ে দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি)। এর বাইরে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি থানা বা আদালতে মামলা করতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনেও মামলা হতে পারে। কিন্তু এসবের কোনটিই খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। লোকজন জানেই না অভিযোগ কোথায় করতে হবে। দ- ॥ প্রস্তাবিত আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনরকম অবহেলার অভিযোগ কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উত্থাপন করলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত না হলে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা যাবে না। ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আদালত অবহেলার অভিযোগ গঠনের আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (সহযোগী অধ্যাপক/সিনিয়র কনসালট্যান্টের নিচে নন) সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে অবহেলার বিষয়ে মতামতের জন্য পাঠাবেন। ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, পেশাগত দায়িত্ব পালনে বা চিকিৎসা দেয়ায় অবহেলা বা অপরাধসম অবহেলা অপরাধ বলে গণ্য হবে। কিন্তু এ অপরাধ ‘আমল অযোগ্য’ ও ‘জামিনযোগ্য’ হবে। কোন ব্যক্তি স্বাস্থ্যসেবাদানকারীর প্রতি সহিংস আচরণ করলে, প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর চালালে তা আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য হবে বলে প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। আমল অযোগ্য ও জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে পরোয়ানা ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না। পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলে পরেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যাবে। প্রস্তাবিত আইনে চিকিৎসা সেবাদানকারী বলতে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত নিবন্ধিত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, মিডওয়াইফ, চিকিৎসা সহকারী অথবা স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অন্য ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। আইনে সুনির্দিষ্টভাবে সাতটি বিষয়কে পেশাগত নৈতিকতার আওতায় আনা হয়েছে। এগুলোর ব্যতিক্রম ঘটলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ তালিকায় বিএমডিসি স্বীকৃত নয় এমন ডিগ্রী ব্যবহার, কোন বিশেষায়িত বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষিত বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষায়িত চিকিৎসা দেয়ায় যুক্ত হওয়া অপরাধ। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে কোন মিথ্যা প্রত্যয়নপত্র বা বিল দিলে বা রোগীর কাছ থেকে পারিতোষিক বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নিলে সেটিও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার সময় অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দ-বিধির ৩০৪-এর ক ধারা প্রয়োগ করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারায় অনধিক তিন বছর কারাদ-ের বিধান আছে। রোগীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে অনধিক তিন বছরের কারাদ- বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- দেয়ার বিধান থাকছে। তবে রোগী ও তার স্বজনরা আইন অমান্য করলে অনধিক তিন বছর কারাদ- বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে নিয়ম কী যুক্তরাজ্য ॥ যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকদের পেশাগত দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা ও তাদের পর্যবেক্ষণের কাজটি করে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল (জেএমসি)। এটি চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একই সঙ্গে তারা রোগীদের স্বার্থের বিষয়টিও দেখাশোনা করে। দক্ষতা, যোগ্যতা ও রোগীদের কল্যাণ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান যাচাইপূর্বক এ লাইসেন্স ও নিবন্ধন দেয়া হয়। লাইসেন্স বহাল রাখা হবে কি-না, সে বিষয়ে প্রতি বছর চিকিৎসকের সেবা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন করে জেএমসি। চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোন বিরোধে রোগী ও চিকিৎসক অভিযোগ করতে পারে জেএমসিতে। অভিযোগ তদন্তে জেএমসির নিজস্ব তদন্ত দল রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অভিযোগগুলো তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। পেশাগত ভুল, অবহেলা কিংবা অন্য কোন অপরাধ বিবেচনায় চিকিৎসকের লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে। যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগে রোগীকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তবে চরম অবহেলার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ॥ যুক্তরাষ্ট্রে অবহেলার অভিযোগে তাৎক্ষণিক গ্রেফতারের নিয়ম নেই। সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি অভিযোগ আনার পর তদন্ত হবে। ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি বা সরকারী আইনজীবী আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনার পর চিকিৎসককে গ্রেফতার করা যেতে পারে বা তিনি স্বেচ্ছায় আদালতে উপস্থিত হবেন। বিচারক জামিন দেবেন বা জেলে পাঠাবেন। এ ধরনের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় তদন্ত দ্রুত করা হয়। ভারত ॥ ভারতে রোগী অবেদন করার সময়, অস্ত্রোপচারের সময় বা অন্য কোন চিকিৎসা দেয়ার সময় চিকিৎসক যদি অসদুদ্দেশ্যে রোগীর ক্ষতি করেন বা চূড়ান্ত অবহেলা করেন তাহলে ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যাবে। রোগী পক্ষকে অবহেলার বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে এবং চিকিৎসককেও প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি নির্দোষ। ভারতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আদালতেও অভিযোগ দায়েরের সুযোগ আছে। অবহেলা প্রমাণিত হলে রোগী ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকেন। ২০১৪ সালের খসড়া আইন ॥ ‘রোগী সুরক্ষা আইন-২০১৪’ ও ‘স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন-২০১৪’-এর খসড়ায় বলা হয়েছিল, চিকিৎসকের অপরাধ আমল অযোগ্য ও জামিনযোগ্য করা হলেও চিকিৎসক সুরক্ষা আইনে স্বজনদের ক্ষতিসাধনের অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। অভিযুক্ত চিকিৎসককে দুই বছরের কারাদ- অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দ-বিধির ৩০৪ ধারায় মামলা করা হবে। পক্ষান্তরে স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সহিংস কাজ করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে সেবাদানকারী ও প্রতিষ্ঠানের কোন সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, বিনষ্ট করা, ধ্বংসের মতো অপরাধের শাস্তি তিন বছরের সশ্রম কারাদ- এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। এ সংক্রান্ত অপরাধ আমলযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য হবে।
×