ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আফগানিস্তান ৭ রানে পরাজিত

অবিশ্বাস্য জয় ॥ নায়ক তাসকিন

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অবিশ্বাস্য জয় ॥ নায়ক  তাসকিন

মিথুন আশরাফ ॥ কী উত্তেজনা। কী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পরতে পরতে রোমাঞ্চ। শেষ পর্যন্ত কে জিতবে, কে জিতবে? সবার মুখে একই প্রশ্ন। বাংলাদেশই জিতল। কষ্টের জয় মিলল। শেষ বলে গিয়ে ৭ রানের জয় মিলল। সাকিবের দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর শেষমুহূর্তে যে তাসকিন গতির ঝড় তুললেন, তাতেই আফগানরা কুপোকাত হয়ে গেল। একদিকে বাংলাদেশ ওপেনার তামিম ইকবাল। আরেকদিকে বাংলাদেশ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তামিম একটি রেকর্ড গড়লে, পরক্ষণেই সাকিব গড়েন আরেকটি রেকর্ড। রবিবার যেমন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জেতা প্রথম ওয়ানডেতেও ঘটল ঘটনাটি। ব্যাট হাতে ১৫ রান করতেই সব ফরমেট মিলিয়ে প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে ৯ হাজার রান করলেন তামিম। আবার ৮০ রানেও গিয়ে থামলেন। পরক্ষণেই বল হাতে ১ উইকেট নিয়ে তিন ফরমেটেই সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের মালিক হলেন সাকিব। ব্যাট হাতে ৪৮ রান করার পর বল হাতেও শেষ পর্যন্ত ২ উইকেট নিলেন। দলের এ দুই সেরা ক্রিকেটারের নৈপুণ্যে আফগানদেরও প্রথম ওয়ানডে জেতার স্বপ্ন ধূলিসাত হয়ে গেল। ১০ মাস পর ওয়ানডে খেলতে নেমেও সেই জয়ের ধারাতেই থাকল বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়েও গেল। কথায় আছে, ‘ক্যাচ মিস, ম্যাচ মিস।’ দুই দলই ক্যাচ মিস করল। এমনকি ফিল্ডিং মিসও করল। কিন্তু আফগানিস্তানের বেলাতেই সেই কথা ফলল। জয়ের ভাগ্য বাংলাদেশের কপালেই জুটল। বুধবার দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জিতলে সিরিজ জিতে নেবে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলেই বাজিমাত করবে। অবশ্য প্রথম ওয়ানডেতে জেতা নিয়ে একটু ভয়ও যুক্ত হয়। আফগানিস্তান যে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে ২৭ ওভারেই ১২৫ রান করে ফেলে। ৪৬ রানে দুই উইকেট হারানোর পর তৃতীয় উইকেট জুটিতে রহমাত শাহ ও হাসমতুল্লাহ শহীদি মিলে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। ২ রানের সময়ই রানের খাতা খোলার আগেই মোহাম্মদ শাহজাদ আউট হতে পারতেন। কিন্তু স্লিপে ইমরুল কায়েস ক্যাচটি লুফে নিতে ব্যর্থ হলেন। বোলিং এ্যাকশন বৈধ হওয়ার পর আবার বল হাতে নেয়া তাসকিন আহমেদও উইকেটটি পেলেন না। এরপর আবার ১৮ রানের সময় মাশরাফির বলে শাবির নূরীর ক্যাচটি ধরতে পারলেন না রুবেল হোসেন। তখন শাবির মাত্র ৬ রান করেন। দুই ক্যাচ মিসে আফগানিস্তান ৪৬ রানে চলে যায়। এমন সময় যেন ত্রাতা হয়ে ওঠেন মাশরাফি। ৩১ রান করা শাহজাদকে আউট করে দেন। কোন রান যুক্ত না হতেই বল করতে এসেই নিজের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলে শাবিরকে (৯) আউট করে দেন সাকিব। এ উইকেট নিতেই টেস্টে সর্বোচ্চ ১৪৭, টি২০তে সর্বোচ্চ ৬৫ উইকেট নেয়ার পর ওয়ানডেতেও স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকের সমান ২০৭ উইকেট শিকার করেন সাকিব। আগেই তিন ফরমেট মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৪১৮ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব গড়েন সাকিব। শাবিরকে আউট করে টেস্ট, টি২০’র পর ওয়ানডেতেও এখন একমাত্র বোলার হিসেবে প্রতিটি ফরমেটেই আলাদা করে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের মালিক হলেন সাকিব। মনে করা হচ্ছিল, এই বুঝি শুরু হলো আফগান ব্যাটসম্যানদের পতন। কিন্তু সেই ধারণা কিছুক্ষণ যেতেই পাল্টে দেন রহমত ও হাসমতুল্লাহ। কোন চেষ্টাতেই এ দুইজনকে যেন সাজঘরে ফেরানো যাচ্ছিল না। রহমত তো ৩১তম ওভারে রুবেল হোসেনের করা পঞ্চম বলে ছক্কা হাঁকিয়ে অর্ধশতকই করে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর হাসমতুল্লাহও অর্ধশতক করেন। দুইজন মিলে আবার আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়ানডেতে তৃতীয় উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড জুটিও উপহার দেন। ১০৪ রানের বেশি জুটি হতেই সেই রেকর্ড হয়ে যায়। ১৪৩ রানেই এ জুটি থামতে পারত। তখন ৬১ বলে ৭৮ রানের দরকার ছিল। কিন্তু তাইজুলের বলে ৬৩ রান করা হাসমতুল্লাহর ক্যাচটি ধরতে ব্যর্থ হন রিয়াদ। এমন সময়ে যেখানে এ জুটি ভাঙ্গা জরুরী, সেখানে এ ক্যাচ মিস করে কেউ? এমন প্রশ্নই তখন উঠে। তবে সেই প্রশ্ন উঠতে না উঠতেই সাকিবের বলে ৭১ রান করা রহমত স্টাম্পিং হয়ে যান। রহমত-হাসমতের জুটিও ১৪৪ রানে ভেঙ্গে যায়। সাকিব যেন ত্রাতা হয়ে আসেন। সেই সঙ্গে রহমতের উইকেটটি নিতেই টেস্ট, টি২০’র পর ওয়ানডেতেও বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ডও নিজের করে নেন। সাকিবের পর তাইজুলও যেন বাংলাদেশকে ‘লাইফ লাইন’ এনে দেন। ৪১ বলে ৫৬ রান দরকার। এমন সময় ৭২ রান করা হাসমতুল্লাহকে আউট করে দেন তাইজুল। রিয়াদ এর আগে ভুল করলেও সৌম্য ভুল করেননি। তাইজুলের ছোড়া লো বলটি সুইপ করেন হাসমতুল্লাহ। ডিপ মিডউইকেটে ক্যাচ ধরেন সৌম্য। পেস বল খুব ভাল খেলতে থাকেন আফগান ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু স্পিনে যে খুবই দুর্বল তা বোঝা গেছে। আর তাই দুই স্পিনার সাকিব ও তাইজুলই ভরসা হয়ে ওঠেন। তাতে কী দুইজন তো করতে পারবেন ১০ ওভার করে ২০ ওভার। শেষমুহূর্তে যখন ৩০ বলে ৩৮ রান দরকার, তখন শুধু সাকিবের ১ ওভারই বাকি থাকে। এখানেই যেন এগিয়ে যায় আফগানিস্তান। গত বছর জুড়ে ওয়ানডেতে যে পেস আক্রমণ বাংলাদেশের শক্তি ছিল। পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালস যুগে যেন সেটিই নেতিয়ে পড়তে শুরু করে দিল। আফগান ব্যাটসম্যানদেরই ভোগাতে পারলেন না পেসাররা। তিন পেসার নিয়ে খেলতে নেমে শেষদিকে পেস আক্রমণ ছাড়া আর কোন গতিই থাকল না। তবে সেই পেসেই আরেকটি উইকেট গেল। ২৩০ রানের সময় মাশরাফির বলে নজিবুল্লাহ (৭) আউট হয়ে যান। এরপরও ভয় থাকে। আসগার স্ট্যানিকজাই যে তখনও ব্যাটিংয়ে থাকেন। স্ট্যানিকজাই ব্যাট হাতে নেমেই মাশরাফির বলে ছক্কা হাঁকান। ২৪ বলে জিততে ২৮ রানের প্রয়োজন থাকে। এমন সময় সাকিব তার শেষ ওভার করতে আসেন। ওভারটিতে মাত্র ১ রান দেন। ১৮ বলে জিততে ২৭ রানের দরকার থাকে। বল হাতে নেন তাসকিন। এ ওভারের আগে যার ৬ ওভারেই ৪৯ রান আসে। বোলিং এ্যাকশন বৈধ হওয়ার পর যেন নিষ্প্রভ হয়ে যান তাসকিন। তাসকিনকে না দিয়ে কোন উপায়ও নেই। মাশরাফি, সাকিব, তাইজুলের যে ১০ ওভার করে শেষ হয়ে যায়। তাসকিনই শেষমুহূর্তে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেন। চতুর্থ বলে নবীকে (৩০) আউট করে দেন। ওভারের শেষ বলে গিয়ে স্ট্যানিকজাইকেও (১০) আউট করে দেন তাসকিন। যে রিয়াদ একটু ফিল্ডিংয়ে ঝিমিয়ে পড়েছিলেন, তিনিই ক্যাচটি ধরেন। বাংলাদেশকে যেন জয়ের কাছেই নিয়ে যান। আশা জেগে যায়। শেষ ১২ বলে ২১ রানের প্রয়োজন থাকে। রুবেল বল হাতে নেন। পঞ্চম বলে রশিদ দুর্দান্ত একটি বাউন্ডারি হাঁকান। শুয়ে শট মেরে উইকেটরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকান। ষষ্ঠ বলে একইভাবে মারতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান। এবার শেষ ওভারে ১৩ রান দরকার থাকে। তাসকিন বল হাতে নেন। প্রথম বলে ২ রান হলেও দ্বিতীয় বলেই মিরওয়াইসকে (৩) এলবিডব্লিউ করে দেন তাসকিন। তৃতীয় বলে ১ রান দেন। ৩ বলে জিততে আফগানিস্তানের লাগে ১০ রান। চতুর্থ বলে ২ রান হলো। এখনও যে কোন দল জিততে পারে। যদি একটি ছক্কা হয়ে যায়, তাহলেই বাংলাদেশের হার হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। পঞ্চম বলে কোন রানই হলো না। সেখানেই জেতা নিশ্চিত হয়ে গেল। ১ বলে যে জিততে ৮ রান লাগে। শেষ বলে জাদরানকেও (২) আউট করে দিয়ে বাংলাদেশকে জিতিয়ে দিলেন তাসকিন। ২৫৮ রানের বেশি করতে পারল না আফগানিস্তান। তবে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েছে, তাতেই সাধুবাদ পাচ্ছে আফগানরা। তাসকিন ৪ উইকেট ও সাকিব ১০ ওভারে ২৬ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন। এর আগে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই সৌম্য সরকারের উইকেটটি হারায় বাংলাদেশ। এরপর দ্বিতীয় উইকেটে তামিম ও ইমরুল কায়েস মিলে ৮৩ রানের জুটি গড়েন। যা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে ৯ ও ১৩ রানে ইমরুল এবং ৩০ রানে তামিম ‘নতুন জীবন’ও পান। আফগান ফিল্ডারদের ক্যাচ মিসের সুযোগটি দুই জনই নেন। ইমরুল ৩৭ রান করে আউট হলেও তামিম উইকেট আঁকড়ে থাকেন। এবার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৭৯ রান যোগ করেন তামিম। দলের স্কোরবোর্ডে ১৬৩ রান যোগ হতেই ৮০ রান করে আউট হয়ে যান সব ফরমেট মিলিয়ে ৯ হাজার রান করা তামিম। আউট হওয়ার আগে ওয়ানডেতে মোট ৪৭৯৩ রান করেন। আর টেস্টে আগেই সর্বোচ্চ ৩১১৮ ও টি২০তে সর্বোচ্চ ১১৫৪ রান ছিল তামিমের। তামিম আউট হওয়ার পর এবার রিয়াদ ও সাকিব মিলে দলকে ২০৩ রানে নিয়ে যান। এর মধ্যে রিয়াদও ৬২ রান করে ফেলেন। রিয়াদ আউট হতেই যেন ভরাডুবি শুরু হয়ে যায়। রানের চলমান গতি থামতে থাকে। যেখানে ২০৩ রানে ৪ উইকেটের পতন ঘটে। সেখানে আর ৬২ রান যোগ হতেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। শেষ ৬ ব্যাটসম্যানের মধ্যে সাকিব ৪৮ রানের ইনিংস করতে পারেন। বাকিদের মধ্যে তাইজুল (১১) শেষদিকে একটু ঝলক দেখান। ব্যর্থ হন মুশফিক (৬), সাব্বির (২), মাশরাফি (৪) ও তাসকিন (২)। দাওলাত জাদরান একাই ৪ উইকেট তুলে নেন। শেষ ১০ ওভারে ৬৯ রান করতে পারে বাংলাদেশ। এখানেই পিছিয়ে পড়ে যেন। আরও বেশি রান হতে পারত। কিন্তু শেষদিকে আফগান বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের চাপে পড়ে রানের গতি কমে যাওয়াতেই বিপদ আসে। আফগান ব্যাটসম্যানরাও বাংলাদেশকে বিপদে ফেলে। তবে শেষ বলে গিয়ে হার হয়। বাংলাদেশ কষ্টের জয় তুলে নেয়।
×