ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থমন্ত্রী বলছেন, প্রকল্প ওব্যাংকের কার্যক্রম একসঙ্গে চলতে পারে না

রশি টানাটানি

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রশি টানাটানি

এম শাহজাহান ॥ দুই মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানিতে ভেস্তে যেতে বসেছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ চলছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, প্রকল্প ও ব্যাংক একসঙ্গে চলতে পারে না। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আইন অনুযায়ী এর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ এবং দায়-দেনা এখন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের। তাই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে সকল সদস্যের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে। তবে এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, প্রকল্পটি এখন ধ্বংস হতে চলেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের যন্ত্রণা থেকে গরিব মানুষকে মুক্তি দিতে হলে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করে আরও ৩৬ লাখ পরিবারকে এ প্রকল্পের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। জানা গেছে, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব উঠায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না। কারণ এই প্রকল্পের সবক’টি ব্যাংক হিসাব এখনও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় অফিস স্থাপনসহ যাবতীয় ফার্নিচার ও আসবাবপত্র কেনা হয়েছে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের নামে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের দিয়েই ব্যাংকটির কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাই এসব বিষয়ের মীমাংসা ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় চাইলেও আপাতত ব্যাংকিং কার্যক্রমে যেতে পারছে না। তাই প্রকল্পটি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সঙ্গে চালিয়ে নেয়া হবে, না একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া এখন জরুরী হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রকল্পটি চালু করেছিল স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়। কিন্তু পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গঠনের পর এটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে চলে গেছে। জানা গেছে, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কিভাবে পরিচালিত হবে এবং ব্যাংকের অধীনে প্রকল্পটি চালিয়ে নিলে কি ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে, কিংবা যৌথভাবে পরিচালিত হতে পারে কি না সেসব বিষয়ের ওপর একটি সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরেকটি প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। এই দুটি প্রতিবেদনই দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রীকে। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব প্রশান্ত কুমার রায় জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠিত একটি সফল প্রকল্পকে ধ্বংস করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ইচ্ছায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সফল এই প্রকল্পটিকে আরও সফল করতে আরও পাঁচ বছর সময় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ৪০ হাজার ২১৪টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়েছে। সমিতিতে প্রায় ২২ লাখ সদস্য তথা পরিবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত সদস্যদের নিজস্ব সঞ্চয় ৯৭০ কোটি ২২ লাখ এবং বিপরীতে সরকার প্রদত্ত বোনাস ও আবর্তক তহবিল ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সার্ভিস চার্জ, ব্যাংক সুদ ও সম্পদের অর্থ আদায়সহ প্রকল্পের আওতায় গঠিত সমিতির মোট তহবিলের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৫২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সমিতির সমুদয় তহবিল আইন অনুযায়ী পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবে। জানা গেছে, আইন অনুযায়ী পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের যাত্রা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের বিলুপ্তির কথা থাকলেও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব আসায় ব্যাংকের কাজে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। সমিতির তহবিল থেকে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যে গঠিত ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন যোগানোর কথা থাকলেও এই কারণে তা না পাওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধনী অনুমোদন দিলে তার সম্ভাব্য জটিলতা দেখিয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মিহির কান্তি মজুমদার। তবে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প পরিচালক আকবর হোসেন বলছেন, তারা প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন, এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সরকারের। সমন্বিত গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কার্যাবলীর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াসে ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি নিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১৪ সালে শেষের কথা থাকলেও পরে ব্যয় ১ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। এরপর দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় ৩ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় উন্নীত করে মেয়াদ ২০১৬ সালে জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পের কর্মসূচী অব্যাহত রেখে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন ২০১৪ পাস করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী গত ২২ জুন ব্যাংকটির ১০০টি শাখা উদ্বোধন করেন। তবে প্রকল্পের সমিতিগুলো থেকে ৪৯ শতাংশ তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন যোগানের কথা ছিল। এর মধ্যেই প্রকল্পটি বিলুপ্ত না করে আরও প্রায় ৫ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে ২০২০ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করতে প্রস্তাব পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। তার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য জটিলতার চিত্র তুলে ধরে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এ এন সামসুদ্দিন আজাদের কাছে সম্প্রতি চিঠি পাঠান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার। নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে তিনি ওই চিঠিতে জানিয়েছেন, জুনে প্রকল্পের সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পটি বিলুপ্ত হয়ে এর সম্পদ, দায়, কর্মসূচী পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি আইনানুগ নয়। তিনি বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ৪০ হাজার ২১৪টি সমিতি সমবায় সমিতি করার জন্য পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ থেকে একাধিকবার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গত বছরের ১৯ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত প্রকল্পর উপদেষ্টা কাউন্সিলের সভায়ও সমিতিগুলোকে সমবায় সমিতি করার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। কিন্তু একটি সমিতিও সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধন করা হয়নি। ফলে সমিতির অডিট হয় না, এজিএম হয় না, নির্বাচন হয় না এবং সমিতির নিজস্ব কোন তহবিল গঠিত হয়নি। শুধু তাই নয় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে সমিতিগুলো আরও দুর্বল হবে এবং প্রকল্পের ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অনেক ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক চেয়ারম্যান। চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, সমিতির নিজস্ব তহবিল সৃষ্টি হয়নি বিধায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমিতির অংশ (৪৯ শতাংশ) ৯৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করা যায়নি। এতে এ প্রক্রিয়া আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে ১ লাখ সমিতির (পুরাতন ৪০ হাজার এবং প্রস্তাবিত ৬০ হাজার) জন্য ৫ লাখ সদস্যকে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা সম্ভবপর নয় বলে মিহির কান্তি মজুমদারের দাবি। প্রকল্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার জন্য ১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, যার ১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা ইতোমধ্যে সমিতিকে দেয়া হয়েছে। ব্যাংক হিসাব নিয়ে ক্ষোভ ॥ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বিদ্যমান সমিতিগুলোর হিসাব খোলা হয়েছে তিনটি বেসরকারী ব্যাংকে। বেসরকারী ব্যাংকের শাখা উপজেলা পর্যায়ে খুবই কম। ফলে অনলাইনে ঋণ মঞ্জুর হলেও দিনের পর দিন সদস্যদের টাকার জন্য বসে থাকতে হয়। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সরকারী ব্যাংকের শাখা দেশের সব উপজেলায় বিস্তৃত থাকলেও অনলাইনের যুক্তিতে বেসরকারী তিনটি ব্যাংকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেন হচ্ছে। একটি ব্যাংক ৩৪ জেলা এবং অপর দুটি ব্যাংকের কার্যক্রম ৩০ জেলায় রয়েছে।
×