ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৭ অক্টোবর ষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে পূজা শুরু, ১১ তারিখে বিজয়া দশমী

এবার সারাদেশে ২৯ হাজারের বেশি মন্দিরে দুর্গাপূজা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এবার সারাদেশে ২৯ হাজারের বেশি মন্দিরে দুর্গাপূজা হচ্ছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সারাদেশে ২৯ হাজার ৩৯৫ পূজা ম-পে শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। যা গতবারের তুলনায় তিনশ’টি বেশি। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের প্রাথমিক হিসেবে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে ঢাকা মহানগরে ২৩০ ম-পে দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গত বছর ২২৬ ম-পে আয়োজন করা হয়েছিল। অর্থাৎ এবছর রাজধানীতে পূজার সংখ্যা বেড়েছে চারটি। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৬০০ পূজার আয়োজন হয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ বলছেন, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী ও জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে এ বছর পূজার সংখ্যা বেড়েছে। তবে সর্বজনীন এই উৎসবকে নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক রয়েই গেছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতা শতভাগ নিশ্চিত হলে সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে শারদীয় এই উৎসব উদযাপন সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা। বাঙালী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলছে আরও আগে থেকেই। ম-পে ম-পে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পীরা। বেশিরভাগ প্রতিমা নির্মাণের কাজ শেষ। চলছে রং তুলির কাজও। ইতোমধ্যে পূজার কেনাকাটা শুরু হয়েছে। বিপণি বিতানগুলোয় বাড়ছে ক্রেতাদের ভিড়। উৎসবের পূর্ণতা দিতে ব্যস্ত ফ্যাশন হাউসগুলো। উৎসবকেন্দ্রিক পোশাক তৈরিতে দর্জিদেরও দম ফেলার সময় নেই। নানা রকমের অফার নিয়ে হাজির হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার পাল জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর সারাদেশে ২৯ হাজারেরও বেশি পূজা ম-পে শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েকমাস আগেও পূজার আয়োজন নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আতঙ্কিত ছিল। একের পর এক পুরোহিতসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনে কঠোর ভূমিকা নেয়। এতে সবার মধ্যে আস্থা বেড়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে আতঙ্ক অনেকটাই কেটেছে পূজার সংখ্যাও বেড়েছে। তিনি বলেন, তবুও কিছুটা ভয় রয়েই গেছে। অনেকের মন থেকে আতঙ্ক একেবারে কাটছে না। যদিও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। তবুও আমি মনে করি রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রশাসনিক সহযোগিতা শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সারাদেশে এবারও নির্বিঘেœ উৎসব হবে। আগামী ২০ আশ্বিন, সাত অক্টোবর ষষ্ঠী পূজা। ১১ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে পাঁচদিনব্যাপী উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে। উৎসব উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে এক বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়। এতে দেশের সকল জেলার পূজা কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভায় বক্তারা দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ম-পের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করেন। তারা উৎসবের আঙ্গিকে দুর্গোৎসব উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান। পূজা আয়োজনে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে বলেও সভায় উল্লেখ করা হয়। তবে দেশের কয়েকটি স্থানে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন বক্তারা। সভায় দুর্গাপূজায় তিন দিনের সরকারী ছুটি, প্রতিটি ম-পে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পূজার সময় গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ভবন ও সড়কে আলোকসজ্জার দাবি জানানো হয়। পূজার আয়োজনে পিছিয়ে নেই রাজধানী ঢাকাও। পুরনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। চলছে পুরোদমে প্রস্তুতি। আগামী সপ্তাহ থেকেই শুরু হবে আলোকসজ্জার কাজ। নগরীর প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ সাহা মণি বলেন, এবার পূজার প্রস্তুতি বেশ ভাল। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। রাজধানীর ২৩০ ম-পে দুর্গোৎসবের আয়োজনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। কোথাও কোন অঘটন ঘটেনি। ফলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আস্থা ও বিশ্বাস বেড়েছে। এজন্য দুর্গাপূজার সংখ্যাও আগের চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক থাকলেও এবারের দুর্গোৎসবে পুলিশ প্রশাসন ব্যাপক তৎপর। আমরা কোথাও জঙ্গী হামলার আশঙ্কা করছি না। আশা করি ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উৎসবের সফল সমাপ্তি ঘটবে। কেন এই উৎসব ॥ প-িতরা বলছেন, শরৎকালের প্রথম শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে মহালয়ার দিনে দেবীঘট স্থাপন করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। শরতকালের এ পক্ষকে দেবীপক্ষও বলা হয়ে থাকে। শাস্ত্রে আছে, দেবীদুর্গা হিমালয়বাসিনী দক্ষরাজার কন্যা। পিতৃগৃহে আগমন উপলক্ষে ষষ্ঠীর দিনে বিজয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে মর্ত্যলোকে মা দুর্গার আগমনকে স্বাগত জানানো হয়। এটিই দেবীর বোধন। এরপর যথাক্রমে মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীতে কুমারী ও সন্ধিপূজা এভাবে নবমী পার হয়ে দশমীর দিনে দেবী বিসর্জন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও পক্ষকাল চলে বিজয়া পুনর্মিলনী উপলক্ষে বিভিন্ন লোকজ উৎসব। পুরাণে দেবী দুর্গার আবির্ভাব তত্ত্বে বলা হয়েছে সমাজের সব অশুভ শক্তির বিনাশে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আবির্ভাব। ত্রেতাযুগে অসুরদের দাপটে সমগ্র মানবজাতি যখন উৎকণ্ঠিত তখন মানবকল্যাণে ধরাধামে আবির্ভূত হন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র। তিনি পিতার আদেশে বনবাস যাপনকালে লঙ্কেশ্বর রাবণ তার পতœী সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় লুকিয়ে রাখেন। লঙ্কাপুরী থেকে প্রিয়তমা পতœী সীতাকে উদ্ধারের জন্য শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশে শ্রী রামচন্দ্র শরতকালে দুর্গা দেবীকে মর্ত্যে আহ্বান করেন। ‘বোধন’ শব্দের অর্থ জাগ্রত করা। বসন্তকালের পরিবর্তে শরতকালে আহ্বান করায় এ পূজাকে অকালবোধন বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই শরতকালে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। দেবী দুর্গার সৃষ্টি-রহস্যসমৃদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীশ্রীচ-ীতে উল্লেখ আছে, ব্রহ্মা মহিষাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন কোন পুরুষ তোমাকে বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মার বর পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মহিষাসুর। একে একে বিতাড়ন করেন স্বর্গের সব দেবতার। উপায়ন্তর না পেয়ে দেবতারা অবশেষে ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু কী করবেন তিনি। নিজের দেয়া বর ফেরাবেন কী করে? এ অবস্থায় শিব ও অন্যান্য দেবতা সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মা যান স্বয়ং বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু তাদের দুর্দশার কথা শুনে দেবতাদের বলেন, দেবতাদের নিজ নিজ তেজকে জাগ্রত করতে হবে। তখন দেবতাদের সমবেত তেজের মিলনে আবির্ভূত হবে এক নারী মূর্তি। সেই নারীই বিনাশ করবে মহিষাসুরকে। বিষ্ণুর থেকে সবকিছু অবগত হয়ে দেবতারা হিমালয়ের পাদদেশে পুণ্যসলিলা গঙ্গার সামনে এসে প্রার্থনা শুরু করেন। দেবতাদের সম্মিলিত তেজরাশি থেকে দশদিক আলোকিত করে আবির্ভূত হন এক নারীমূর্তি। ইনিই দেবী দুর্গা নামে অভিহিত। তিনি আবির্ভূত হন দশভুজারূপে। দেবতাদের সব দুর্গতি বিনাশ করায় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, মহিষমর্দিনী এবং অসুরদলনী নামেও পরিচিত। বৈদিক সূত্রে এ দেবীর উল্লেখ আছে। পুরাকালে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল বসন্তকালে। এ সময় দেবী দুর্গা ‘বাসন্তী’ নামে পূজিত হতেন, এখনও বাসন্তী পূজার প্রচলন আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস, অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে দূর হবে সকল পাপ। সমাজে ফিরে আসবে শান্তি। প-িত অশিত চক্রবর্তী জনকণ্ঠকে বলেন, এবছর ঘোড়ায় চরে আসছেন দেবী দুর্গা। এতে রবি শস্য ভাল হবে। দেবী বিদায়ও নেবেন ঘোড়ায় চরে। এতে দূর হবে সকল অসুখ বিসুখ। তিনি বলেন, দেবীর যাত্রার সময় সকল অসুখ বিসুখ ধূলোর সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাবেন।
×