ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সম্মেলন অনুষ্ঠানে গবর্নর

ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী অবস্থানেই রয়েছে

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী  অবস্থানেই রয়েছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা বাদ দিলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী অবস্থানেই রয়েছে। দু’দিনের আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সম্মেলন উদ্বোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর আরও বলেছেন, বাড়তে থাকা খেলাপী ঋণ সংস্কৃতি কমাতে নজরদারি কঠোর করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখন অতিমাত্রায় জ্ঞানভিত্তিক। এর কার্যক্রমেও বেশ গতি এসেছে। ব্যাংকগুলোও এখন গ্রাহকের চাহিদামাফিক বৈচিত্র্যময় আর্থিক সেবা দিচ্ছে। আর এর ফলে ব্যাংকিং ঝুঁকির প্রকৃতি ও মাত্রা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। সদা-পরিবর্তনশীল এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে। গবেষণার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। রবিবার রাজধানীর মিরপুরস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘ব্যাংকার ও গবেষকদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন ২০১৬’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে গবর্নর এসব কথা বলেন। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব বিজনেস এ্যান্ড সোস্যাল সাইন্স’র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এবং যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া এবং সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় বিআইবিএম দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানে গবর্নর বলেন, এই সম্মেলনে অংশ নেয়া গবেষক ও শিক্ষাবিদদের দেয়ার মতামত ও পরামর্শ এবং এখান থেকে পাওয়া গবেষণালব্ধ ফলাফল ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের কার্যকরী নীতি নির্ধারণের খোরাক যোগাবে। ফজলে কবির আরও বলেন, দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চতর নজরদারির পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় আনতে বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী সংস্কার এনেছে। খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজটি নিবিড় তদারকির মধ্যে রেখেছে। মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, খেলাপি হওয়ার সংস্কৃতি, পর্যাপ্ত জবাবদিহি না থাকা ও কাক্সিক্ষত স্বচ্ছতার অভাব সত্ত্বেও সম্প্রসারণশীল ব্যাংক খাত এ দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভালই অবদান রেখে চলেছে। মূলপ্রবন্ধে ড. ফরাসউদ্দিন ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে ঘটে যাওয়া বিশ্বমন্দার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেন এবং এর কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জানান, ওই দুটি অর্থবছরে বাংলাদেশের জনশক্তি ও তৈরি পোশাক রফতানি বেশ খানিকটা বেড়েছিল, যা পরবর্তীতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও বিদেশী মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করেছে। তাছাড়া আমদানি ব্যয় কমে আসায় রফতানিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব ছিল। তাছাড়া কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে দেশে কর্মসংস্থানও তখন বেড়েছিল। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগও তখন নেয়া হয়েছিল। যার ফলে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমে আসে এবং দাফতরিক কাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। যা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করে। বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে সমালোচিত ইস্যুগুলো হলো খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা, অলস তারল্য ও বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবাহের ধীরগতি। এ সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে হলে এমনভাবে গবেষণা করতে হবে যার ফলাফল এক চুল এদিক ওদিক হবে না। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইবিএমের পরিচালক অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী। গতকাল রবিবার ও আজ সোমবার প্রথম দিনে মোট ৬৫টি গবেষণাপত্র সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। তবে গতকাল দিনের প্রথমভাগের অধিবেশনগুলোতে গবেষণাপত্র উপস্থাপকদের অনুপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। উদ্বোধনী অধিবেশনের পরপরই শুরু হওয়া কারিগরি সেশনে বিআইবিএমের ড. মোজাফফর আহম্মদ চেয়ার অধ্যাপক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ পরিচালিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপনের কথা ছিল ৬ জনের। কিন্তু উপস্থিত ছিলেন মাত্র ২ জন। আজ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে পেশাজীবীদের জন্য তিনটি কর্মশালা হওয়ার কথা রয়েছে। আলোচনায় খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছিল তার কারণ হলো, নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি অংশ শেয়ার ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকজন শেয়ার বেচা-কেনা করলে আস্থা থাকবে কি করে? শেয়ারবাজারে আস্থা না থাকার আরেকটি কারণ হলো, শেয়ারবাজার ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা) পুরোপুরিভাবে হয়নি। হয়েছে আংশিকভাবে। এছাড়া যেভাবে ও যাদের নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করার কথা ছিল, তাও করা যায়নি। পুঁজিবাজার বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বিআইবিএমের নেহাল আহমেদ বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ আসে পুঁজিবাজার থেকে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ এখনও ব্যাংকনির্ভর। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলী বলেন, শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে গিয়ে না পাওয়ার নজির অন্য দেশে থাকলেও বাংলাদেশে নেই। এরপরও এখানকার উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারের তুলনায় ব্যাংক থেকে টাকা নিতে বেশি আগ্রহ দেখান। আইনে আছে ৫০ কোটি টাকার বেশি মূলধন হলেই পুঁজিবাজারে যেতে হবে। এরপরও অনেকে পুঁজিবাজারে যাচ্ছে না। এসব নিয়ে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থারগুলোর সমন্বয় সভায় আলোচনা করে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে যে, বড় কোন উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে পুঁজিবাজারে তার কি পরিমাণ অংশগ্রহণ আছে সেটা দেখা হবে। বা পুঁজিবাজারে যাওয়ার শর্ত দেয়া হবে। কেননা বড় বড় ব্যবসায় দেশের মানুষের অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নতি করতে হলে তহবিল ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা বাড়তে হবে। বিনিয়োগকারীর টাকা কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে তার তথ্য প্রকাশ করতে হবে। এ দেশের বিনিয়োগকারীরা জানে না তার অর্থ নিয়ে কোন খাতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। অন্য দেশে তা জানানো হয়। ব্যাংকিং বিষয়ক অন্য এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, খেলাপী ঋণের উচ্চ হারের ফলে বেশি করে প্রভিশন রাখা, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফা, ব্যাংকগুলোর আমানতের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখা (সিআরআর) এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের অতি মুনাফার মনোভাবের কারণে আশানুরূপ হারে ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানো যাচ্ছে না।
×