ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৪রহমান শোয়েব

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ৬ দশক

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ৬ দশক

চারদিকে বর্ণিল আয়োজন। আলোর ঝলকানি। রংবেরঙের ফেস্টুন। তরুণ-তরুণী থেকে বয়োবৃদ্ধ সবাই মিলেমিশে একাকার। সবার মুখেই আলো ঝলমল করছে। একদিকে একদল বসে গল্প করছেন তো অন্যদিকে কেউ কেউ ব্যস্ত সেলফি তুলতে। আবার কেউ কেউ দলবেধে ছুটে বেড়াচ্ছেন এদিক সেদিক। হয়ত কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। প্রিয় মানুষ, বন্ধু বা প্রিয় কোন স্মৃতি। আর সব কিছুই বলে দিচ্ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ পূরণ করছে তার ৬ দশক বা ৬০ বছর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবটা এমনই আলো ঝলমলে ও উৎসবমুখর ছিল। প্রায় ৪ হাজারেরও অধিক নবীন-প্রবীণের মিলনমেলায় গোটা ক্যাম্পাস পরিণত হয়েছিল এক উৎসবের নগরীতে। দলবেঁধে আড্ডা, গান, খুনসুঁটি, স্মৃতিচারণ, খেলাধুলা, একে অপরের খোঁজখবর নেয়া আর সেলফি তোলার হিড়িক ছিল সর্বত্রই। সবকিছু মিলিয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন বলতে যা বোঝায় তার পুরোটাই উপস্থিত ছিল চমেকের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবে। চমেকের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবের স্লোগান ছিল ‘শেকড়ের টানে প্রিয় প্রাঙ্গণে’। এ স্লোগানেই পালিত হয় দু’দিনব্যাপী উৎসব। উৎসবের প্রথম দিন সোমবার বেলা ১১ টায় চমেক ক্যাম্পাসে বৃক্ষরোপণ, বিকেল ৫ টায় বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের ফুটবল ম্যাচ এবং রাত ১০টায় কলেজ মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মঙ্গলবার রাত ১২ টায় ৬০টি আতশবাজি ও ফানুস উড়িয়ে শুরু হয় সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান। ওই দিন সকাল নয়টায় কলেজ মাঠ থেকে একটি শোভাযাত্রাও বের হয়। সকাল সাড়ে ১০ টায় কাটা হয় ৬০ কেজি ওজনের একটি কেক। সোয়া ১১ টায় আজীবন সম্মাননা প্রদান, দুপুরে মেজবান, বেলা ২ টায় স্মৃতিচারণ ও আড্ডা, সন্ধ্যা ছয়টায় র‌্যাফেল ড্র, সাতটায় চমেকসু ও সাবেক শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মঙ্গলবার সকাল থেকেই ছিল টিপটিপ বৃষ্টি। এতে করে উৎসবমুখর পরিবেশে নেমে আসে হতাশার ছায়া। তবে সে হতাশার মেঘ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। দ্রুতই মেঘ সরে গিয়ে আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে পরিবেশ। স্বস্তি ফিরে আসে হাজার হাজার নবীন-প্রবীণের মাঝে। বয়সের ব্যবধান ভুলে সকলেই ফিরে যান জীবনের সেই স্বর্ণালী সময়ে, যৌবনের সময়ে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ভুলে হয়ে ওঠেন একে অপরের বন্ধু। ছাত্র জীবনে যেসব শিক্ষককে ভয়ে এড়িয়ে চলতেন তাদের সঙ্গেও প্রাণ খুলে হাসি আর আড্ডায় মেতে ওঠেন সাবেক ও নবীন শিক্ষার্থীরা। যেন উৎসব ফুরিয়ে গেলে এই সুযোগ আর মিলবে না। শিক্ষকরাও শ্রেণীকক্ষের আচরণ সিন্দুকে তুলে রেখে হয়ে ওঠেন আরও প্রাণবন্ত। তবে শিক্ষকদের এদিন যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি তা হলো ‘স্যার একটু সেলফি তুলি’। স্যাররাও হাসিমুখে সায় দিচ্ছেন তাতে। সেলফিতে ধরে রাখছেন প্রিয় মুহূর্তগুলোর স্মৃতি। আর সেই সুখস্মৃতি অনেকে মুহূর্তেই ছড়িয়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভাগ করে নিচ্ছেন আনন্দগুলো। ক্যাম্পাসে সেলফি আর হইহুল্লোড়ে মেতে ছিলেন সামিয়া খানম। তিনি বলেন, ‘এমন সুযোগ আর কখনও পাব না। অনেক খ্যাতিমান মানুষ, পুরনো বড় ভাই বন্ধুরা এসেছে। তাদের সঙ্গে আজকের দিনের সুখস্মৃতিটুকু ধরে রাখতে না পারলে পুরো আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে।’ তবে এ ধরনের উৎসব নবীন-প্রবীণদের মাঝে মেলবন্ধন তৈরি ও অভিজ্ঞতা আদান প্রদানের বড় ক্ষেত্র বলে মনে করছেন তিনি। অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা প্রাপ্ত কলেজের প্রথম দিকের শিক্ষার্থী ডা. এল এ কাদেরী। ১৯৫৯ সালে তিনি কলেজে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। তিনি বলেন, ‘এই মেডিকেল কলেজের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আর সেসব মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কলেজের সঙ্গে আমি মিশে গিয়েছি। খুব ভাল লাগছে। এত ভাল লাগছে যে চোখে আনন্দাশ্রু চলে আসছে। গত ৬০ বছরে এ প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়েছে হাজার হাজার মানবতার সেবক। নিজ নিজ কর্মস্থলে রেখে চলেছে সাফল্যের অবদান। সেবা করে যাচ্ছে দেশ ও জাতির। তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ৭ জনকে দেয়া হয় আজীবন সম্মাননা। ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা ডা. কাহ আলম বীর উত্তম (মরণোত্তর), ডা. এল এ কাদেরী, অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন, ডা. মোজাম্মেল হক, ডা. বদিউজ্জামান ভুঁইয়া, অধ্যাপক ডা. মো. আবুল ফয়েজকে। দিন শেষে এবার ফিরে যাওয়ার পালা। যা কিনা সবচেয়ে কঠিন। এতদিন পর প্রিয় মুখগুলোর সাক্ষাতের সময়টা যেন অল্পতেই শেষ হয়ে গেল। দিনটা যদি আরও বড় হতো! কতই না মজা হতো। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। বেলা শেষে তাই ফিরে যেতেই হবে। এবার চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রু। একে অপরকে আলিঙ্গন করে ¯েœহ ভরা কণ্ঠে জানায় বিদায়। একেকজন বিদায় নেয়া আর যেন মনে হয় শরীরের অনিবার্য একটি অঙ্গ খোয়া যাচ্ছে। বিদায়গুলো যেন এতটাই যন্ত্রণাদায়ক। সবশেষে কষ্টটাকে আড়াল করে হাসিমুখে বিদায় দেয়ার তুমুল চেষ্টায় ভাঙে চমেকের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবের আয়োজন।
×