ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ব্লু-ইকোনমির অপার সম্ভাবনা ধরতে নীতিমালা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ব্লু-ইকোনমির অপার সম্ভাবনা ধরতে নীতিমালা হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ ব্লু-ইকোনমির অপার সম্ভাবনার সুযোগ নিতে একটি ফলপ্রসূ নীতিমালা প্রণয়ন করা হতে পারে। এ নীতিমালার আওতায় সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসার পর বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনমি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু সমুদ্র সম্পদ আহরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার ঘাটতি থাকায় নীল অর্থনীতির সুযোগ নিতে পারছে না বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, বিগ-বি ইনিশিয়েটিভের আওতায় বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে জাপান এ দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও বিশাল সমুদ্র সম্পদের ব্যবহার বাড়ানো জরুরী হয়ে পড়েছে। এই বাস্তবতায় এবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শীঘ্রই এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের আহ্বান করা হয়েছে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বিশাল সমুদ্রসীমা পাওয়া গেলেও ব্লু-ইকোনমির বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রথম থেকেই ঢিলেমি ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন মেয়াদী পদক্ষেপ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। শুধু তাই নয়, ব্লু-ইকোনমি সংক্রান্ত একটি জাতীয় কর্মশালা করার কথা থাকলেও তা হয়নি। যদিও সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তদারকির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ কমিটি সময়ে সময়ে সভা করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তাদের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়ার তাগাদা দিলেও বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। ওই বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমন্বয় কমিটির সকল সদস্যকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, বিশাল সমুদ্রসীমা জয়লাভের পর ব্লু-ইকোনমি এখন বাংলাদেশকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সমুদ্র সম্পদ আহরণ এবং সেই সম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকার। তিনি বলেন, কমিটির সদস্য হিসেবে কয়েকটি সভায় অংশগ্রহণ করেছি। তবে পুরো বিষয়টি দেখভালের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে। আশা করছি, ব্লু-অর্থনীতিতেও আমরা জায়গা করে নিতে সমর্থ হব। এজন্য একটি কার্যকরী ও ফলপ্রসূ নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরী হয়ে পড়ছে। এদিকে সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমন্বয় কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সমুদ্রের কোন কোন এলাকায় কী কী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রয়েছে সে বিষয়ে দ্রুত জরিপে এ মন্ত্রণালয়ের কোন আধুনিক জাহাজ নেই। বেশির ভাগ জাহাজে একটি ইঞ্জিন থাকায় ফিশিং বোটগুলো ৩৫ কিলোমিটারের বাইরে যেতে পারে না। অথচ সমুদ্রের ৬৬৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বাংলাদেশের এলাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কার জাহাজ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় তারা গভীর সমুদ্রের মাছ ধরতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে লং লাইন দিয়ে মাছ ধরা হয় এবং সমুদ্রে এ্যাকুয়াকালচারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বাড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ থাকার পরও লং লাইন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না। সমুদ্রে এ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতির ব্যবহারও শুরু হয়নি। এছাড়া সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দক্ষ জনবল গড়ে উঠেনি। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজস্ব জাহাজের পাশাপাশি ভাড়ায় জাহাজ সংগ্রহের পদক্ষেপ নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ। মৎস্য অধিদফতরের মাধ্যমে মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সম্ভাব্য জরিপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে, বিশেষ করে সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে আকাশপথে যাতায়াতকারী আন্তর্জাতিক রুটের ওপর বাংলাদেশের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বাংলাদেশের মেরিটাইম এরিয়ার ওপর দিয়ে যাতায়াতকারী আন্তর্জাতিক রুট এল-৫০৭ কলকাতা বিমানবন্দর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বৈঠকে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মধ্যে সি ক্রুজ বা কোস্টাল ট্যুরিজমের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৯৭ সালে অনুমোদিত হলেও এখনও পর্যন্ত এর কোন কার্যক্রম শুরু হয়নি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এস্টুয়ারি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ভোলার দক্ষিণে চর মাইনকা ও চর মনতাজে দুটি ক্রস ড্যামের নক্সা চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার তেল, গ্যাস ও মৎস্যসম্পদ আহরণ করতে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য ১৬০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের কলাতলী থেকে ইনানী পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণে প্রথম পর্যায়ের কাজ বাস্তবায়নের পর ইনানী থেকে সিলখালী পর্যন্ত কাজ বাস্তবায়ন চলছে। সীতাকু- থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে ২০১৫ সালে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বৈঠকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে গত অর্থবছরে সমুদ্রপথে ৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এজন্য ৬০০ কোটি ডলার জাহাজ ভাড়া দিতে হয়েছে। অধিকাংশ জাহাজ বিদেশী মালিকানাধীন থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই বিদেশে চলে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১০৫ মিলিয়ন ইউরোতে ইতালি থেকে চারটি জাহাজ কেনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মালিকানাধীন বঙ্গোপসাগরের তলের গঠন বিবেচনায় এ অঞ্চলে তেল-গ্যাস ছাড়াও ররুটাইল, ইলমেনাইট, গারনেট, মোনাজাইট, ম্যাগনেটাইট, কায়ানাইট, লিউকক্সিন ও জিরকনসহ নানান ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপকদের মতে, বঙ্গোপসাগর গ্যাস সম্পদের জন্য একটা ভাল জায়গা। ভারতের সমুদ্রএলাকা ও মহানন্দা বেসিনে গ্যাস হাইড্রেট পাওয়া গেছে। এই গ্যাস হাইড্রেট বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরেও পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে (ডিসিসিআই) এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও সুরক্ষায় আমাদের অনেক গবেষণা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রিসার্চ কাউন্সিল গড়া হয়েছে। তবে আমরা এখনই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পারব না। তবে ব্লু-ইকোনমির বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান রাখে- এমন জনবল তৈরিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
×