ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশ গার্মেন্টসে নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেও অনেক কলকারখানায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে শ্রমিক

কলকারখানায় দুর্ঘটনার নেপথ্যে ॥ কম পুঁজিতে বেশি মুনাফার মানসিকতা

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কলকারখানায় দুর্ঘটনার নেপথ্যে ॥ কম পুঁজিতে বেশি মুনাফার মানসিকতা

রহিম শেখ ॥ তাজরীনে অগ্নিকা- এবং রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে নিরাপত্তা ইস্যুতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। প্রায় ৯০ শতাংশ কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। পোশাক মালিকদের ভাষ্যমতে, আপাতত তৈরি পোশাক শিল্পে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা নেই। কিন্তু দেশে পোশাক কারখানা ছাড়াও অনেক কলকারখানা রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা কাজ করেন। এসব কারখানার অধিকাংশই পুরনো। নেই অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও নানা সংস্থার তথ্য বলছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৬টি। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজারের মতো শ্রমিক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প কারখানা বিনির্মাণে উদ্যোক্তারা যতটা মনোযোগী, ততটাই উদাসীন এর নিরাপত্তা নিশ্চিতে। মূলত স্বল্প পুঁজিতে বেশি মুনাফা করার প্রবণতার ফলে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে ঘটছে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা। গত দুই দশকে শিল্প দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই সময়ে সবেচেয়ে বেশিসংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটেছে পোশাক কারখানায়। ভবন ধস ও অগ্নি নিরাপত্তাজনিত কারণেই অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সারেকা গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে মারা যান ২৭ জন। ১৯৯৫ সালে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের লুসাকা এ্যাপারেলসে নিহত হন ১০ গার্মেন্টস কর্মী। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সানটেক্স লিমিটিডের কারখানায় ১৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যান। ১৯৯৭ সালে ঢাকার মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টসে ২৭ জন ও মিরপুর মাজার রোডের রহমান এ্যান্ড রহমান এ্যাপারেলস কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ২২ জন সেলাই শ্রমিক। ২০০০ সালের ২৫ নবেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৫৩ শ্রমিক। একই বছর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে মারা যান ১২ জন শ্রমিক। ২০০১ সালের ৮ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুন ধরার গুজবে ভিড়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন ২৪ গার্মেন্টস শ্রমিক। তারও এক সপ্তাহ আগে মিরপুরের কাফরুলে অগ্নিকা-ে আরও ২৬ শ্রমিক প্রাণ হারান। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা-ে ৪৮ শ্রমিক নিহত হন। ওই বছরের ৩ মে মিসকো সুপার মার্কেট কমপ্লেক্সের এক গার্মেন্টসে আগুন লাগলে মারা যান ৯ শ্রমিক। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল সান নিটিং নামে একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুনে ২০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কে টি এস এ্যাপারেলস মিলে আগুন ধরলে ৬৫ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। ওই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিহত হন ছয়জন। একই বছরের মার্চ মাসে সায়েম ফ্যাশন লিমিটেডে আগুনে তিন মহিলা শ্রমিক নিহত হন। ২০১০ সালে গার্মেন্টসে দুটি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সদরের গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকা-ে মারা যান ২১ জন শ্রমিক। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে ৩০ শ্রমিক মারা যান। ২০১২ সালেই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে। আশুলিয়ায় তোবা গ্রুপের ওই কারখানায় অগ্নিকা-ে মারা যান ১১২ জন। স্থাপত্য নক্সায় বড় ধরনের ত্রুটি ছিল ভবনটিতে। বহির্গমনের সিঁড়িও ছিল না নিয়মানুযায়ী। এর পরের বছর ঘটে সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনাটি। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১ হাজার ২৩৯ জনের বেশি। ভবনটিতে ছিল পাঁচটি পোশাক শিল্প-কারখানা। ভবনের অনুমোদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণ-পরবর্তী তদারকি প্রতিটি পর্যায়েই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। সর্বশেষ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটে আরও একটি বড় শিল্প দুর্ঘটনা। এটিও ঘটে বাংলাদেশে ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামে একটি প্যাকেজিং কারখানায়। বয়লার বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট আগুনে ৪০ বছরের পুরনো ভবনটি ধসে পড়ে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা জানা গেছে ৩৫। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তাজরিন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর নেয়া পদক্ষেপে পোশাক শিল্পের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। পোশাক শিল্পের শ্রমিক কর্মীদের নিরাপত্তায় নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এদেশে কমপ্যাক্ট, এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব পদক্ষেপে কারখানাগুলোতে কর্ম পরিবেশের উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প একটি রোল মডেল। বিজিএমইএ’র সভাপতি বলেন, ২০১৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্সের মেয়াদ রয়েছে। তারা পোশাক খাতের অগ্রগতিতে কিছু শর্ত দিয়েছে। এর আগেই শর্ত পূরণে সমর্থ হব। বিজিএমইএর পূর্ণ সহযোগিতায় ৩ হাজার ৬৬০টি চালু কারখানা পরিদর্শন সম্পন্ন হয়েছে। কারখানাগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপত্তায় নজরদারি ছিল না বলেই টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এজন্য শুধু তৈরি পোশাক শিল্প নয়, আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজরদারি প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিস বা দমকল বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে। তার প্রমাণ মেলে দুর্ঘটনাস্থলে পানিবাহী গাড়ি ও উদ্ধার কাজ আনুষঙ্গিক পরিচালনার সরঞ্জামের উপস্থিতি থেকে। কিন্তু রাসায়নিক কিংবা অন্য ধরনের দাহ্য পদার্থ রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে, সেখানে আগুন দ্রুত আয়ত্তে আনায় সমস্যা যে রয়ে গেছে, সেটা ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের ঘটনায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, আমাদের শিল্প খাতের প্রসার ঘটছে; কিন্তু ঝুঁকি সর্বনিম্ন মাত্রায় কমিয়ে রাখার সক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার আলী আহাম্মেদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, শিল্পায়নের শুরুতে নিরাপত্তার বিষয়ে মালিকদের উদাসীনতাই বর্তমান দুর্ঘটনাগুলোর মূল কারণ। তবে রানা প্লাজা ও তাজরীন ঘটনার পর দেশের শিল্পগুলোর মধ্যে পোশাক খাতের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। তার পরও অনেক খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সময় এসেছে দেশের সব শিল্প খাতে সমান মনোযোগী হওয়ার। তবে লোকবলসহ সরকারী সংস্থার সামর্থ্য ও ক্ষমতায়নের ঘাটতি আছে। নিরাপত্তা জোরদারে এগুলো নিশ্চিত করা জরুরী। কর্মক্ষেত্রে কর্মীর পেশাগত নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (ওশি) ফাউন্ডেশন। শিল্প দুর্ঘটনার ভয়াবহতার জন্য সরকারী নজরদারি ও তদারকিতে সামর্থ্যরে ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন সংস্থাটির ভাইস চেয়ারপার্সন ড. এসএম মোর্শেদ। তিনি বলেন, নজরদারি ও তদারকি ঘাটতির পাশাপাশি সরকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এ সমন্বয়হীনতা দূর না হলে শিল্প দুর্ঘটনার ভয়াবহতার ব্যাপ্তি ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। শিল্প মালিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রানা প্লাজা ও তাজরীনের পর পোশাক শিল্প মালিকদের মানসিকতায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে সামগ্রিক শিল্প খাত বিবেচনায় মালিকদের উদাসীনতা এখনও কাটেনি।
×