ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দখল দূষণের হুমকিতে অধিকাংশ নদনদী;###;আজ বিশ্ব নদী দিবস

স্বাধীনতার পর ৪৪ বছরে ২২ হাজার কিমি নৌপথ বিলুপ্ত

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

স্বাধীনতার পর ৪৪ বছরে ২২ হাজার কিমি নৌপথ বিলুপ্ত

শাহীন রহমান ॥ আজ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্প বর্জ্যরে দূষণ, নদীর অবৈধ দখল, অতিরিক্ত পলি জমে ভরাট হয়ে আজ দেশের অধিকাংশ নদ-নদী হুমকির মুখে পড়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদ-নদীর ভবিষ্যত নিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর শঙ্কা। উজানে সীমান্তের ওপারে বাঁধ তৈরি করে এক তরফা পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে নদীগুলোতে দেখা দিয়েছে নাব্য সঙ্কট। প্রতিবছর নদীগুলো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ১.২ বিলিয়ন টন পলি বহন করে নিয়ে যায়। এই অতিরিক্ত পলি জমে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার চার নদীসহ শহরের বুক দিয়ে বয়ে চলা অধিকাংশ নদ-নদী শিল্প বর্জ্যরে দূষণে নদীর প্রাণ বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর বুকেই চলছে অবৈধ দখলও। বাংলাদেশে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা কত তা নিয়ে সরকারী বিভিন্ন সংস্থার হিসাবের মধ্যে গড়মিল রয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে বাংলাদেশে শাখা প্রশাখা মিলিয়ে নদীর সংখ্যা ৩১০টি হবে। তবে নদী রক্ষায় গঠিত কমিশনের হিসাব মতে দেশে প্রধান নদ-নদীর সংখ্যা রয়েছে ৫৭টি। এর মধ্যে ৫৪টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাকি ৩টি নদী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে নদনদীর প্রকৃত সংখ্যা যাই হোক না কেন গত ২শ’ বছরে দেশের নদনদীর গতি প্রকৃতি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে আজ অনেক নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। অনেক নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। অনেক নদী দখল ও দূষণের কারণে তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলেছে। দেশ স্বাধীনের পর বিআইডব্লিউটিআইয়ের পক্ষ থেকে যে জরিপ চালানো হয়েছিল তাতে বাংলাদেশে নৌপথের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। অথচ সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপে দেশের নৌপথের পরিমাণ দেখানো হচ্ছে মাত্র চার হাজার কিলোমিটার। তাও আবার শুষ্ক মৌসুমে এর পরিমাণ আরও নিচে নেমে আসছে। নদী পথ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো ১.২ বিলিয়ন টন পলি বহন করছে। এই অতিরিক্ত পলি ভরাট হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্য সঙ্কট তৈরি করছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানিতে পাড় উপচে সৃষ্টি করছে বন্যা। আবার একই কারণে শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীতে নাব্য থাকে না বললেই চলে। পলি পড়ে ভরাট হওয়ার কারণে শুধু বর্ষা মৌসুম ছাড়া এসব নদীতে পানি থাকে না। পানি সম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, নদী উদ্ধারের জন্য সরকার ড্রেজিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছে। তিনি বলেন, সমস্যা হলো ড্রেজিং করা এত মাটি কোথায় ফেলা হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকায় পোল্ডার তৈরির আগে নদীর পানি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। এ কারণে নদীর বয়ে আনা পলিও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন বাঁধের কারণে নদীর পানি বাইরে যেতে পারছে না। এ কারণে নদীর তলদেশে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত ৪৪ বছরে দেশে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নামকাওয়াস্তে টিকে রয়েছে বড় বড় অনেক নদীপথ। আর ছোট ছোট বহু শাখা নদী এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে। তারা বলছেন, নদ-নদীর এই অপমৃত্যুর কারণে বাড়ছে নদী ভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাস, কমছে আবাদি জমি, বাড়ছে জলাবদ্ধতা। নদীভিত্তিক অর্থনীতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এতে করে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে। বাড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়। বাস্তুহারা ও অভিবাসী হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবে আগামী ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে উপকূলীয় ১২টি জেলার প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আব্দুল মতিন বলেন, অবহেলা ও নিষ্ঠুরতায় নদীমার্তৃক বাংলাদেশের অনেক নদীই আজ প্রায় ইতিহাস। গত একশ’ বছরে মারা গেছে আমাদের অসংখ্য প্রিয় নদ-নদী। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই প্রায় প্রতিদিন জানা যায় নদীর অনেক দুঃসংবাদ। একদিকে নদী দখলের চিত্র, অন্যদিকে প্রতিদিন শত শত টন শিল্প কারাখানার তরল রাসায়নিক বর্জ্য মিশে যাচ্ছে নদীর পানিতে, প্রতিনিয়ত নদীকে করছে দূষিত এবং জলজ বাসস্থানকে করছে বিপন্ন। এই ক্রমাগত দূষণ ও দখলে নদী আজ সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর। তিনি বলেন, দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, নদী-অর্থনীতি ও ভবিষ্যত উন্নয়নের স্বার্থে নদীর পাড় নদীকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে। দেশে দখল দূষণের শিকার হয়েছে কত নদ-নদী আর কতগুলো হুমকির মুখে রয়েছে তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের প্রধান কয়েকটি নদীর কথা বাদ দিলে অধিকাংশ নদীতেই শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ না থাকায় তাই বিলীন হওয়ার পথে দেশের এক তৃতীয়াংশ নদী। কাগজে কলমে দেশে ৩১০টি নদীর অস্তিত্ব থাকলেও তাদের হিসাব মতে প্রায় ১শ’ নদীতে বছরের বেশিরভাগ সময়ই পানি থাকে না। এর মধ্যে অনেক নদী ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে অনেক নদীতে বর্ষা মৌসুমে প্রবাহ কিছু থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নদী বলে মনে হয় না। বাকি সময়ে নদীতে চলে নানা ধরনের চাষাবাদ। সাম্প্রতিক সময়ে নদী ভাঙ্গন অন্যতম সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তের মতো জীবন যাপন করছে। এসব নদী ভাঙ্গন শিকার হওয়ার ব্যক্তির সমাজে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয় না। পানি সম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে উদ্বা¯ুÍতে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, এক সময় যার সহায় সম্পদ সব ছিল নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সে মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। এ কারণে তার পক্ষে নতুন করে সমাজে খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যে বরাদ্দ তা দিয়ে এই বিশাল পরিমাণ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। নদী ভাঙ্গন রোধের কাজ অনেক ব্যয়বহুল। নদীর এক মিটার ভাঙ্গন রোধে ১ লাখ টাকা দিতে হয়। ৫ কিলোমিটার ভাঙ্গন রোধে ব্যয় করতে হয় ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। তিনি বলেন, পানির ভেতরে কাজ এমনি জটিল যে শেষ না করে ফেলে রাখা যায় না। এক বছর অর্ধেক কাজ ফেলে রাখলে পরের বছর প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। তিনি বলেন, ভাঙ্গনরোধ, বন্য নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণসহ সামান্য কাজেই ব্যয় করতে হয় কোটি কোটি টাকা। অথচ এসব কাজে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ মাত্র ৭৫০ কোটি টাকা। নদীর এসব সমস্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে নদী দূষণ ও দখলের মতো বড় একটি সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষণ ও দখলের কারণে ঢাকার চার নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা। চারশ’ বছর আগে এই নদী তীরেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিন যে নদীকে ঘিরে ঢাকা মহানগরী গড়ে উঠেছিল সেই নদী এখন মৃতপ্রায়। নদীর দুই কূল ঘেঁষে অবৈধভাবে দখলের কারণে বুড়িগঙ্গা নদী ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বর্তমানে এটা ধলেশ্বরীর শাখা বিশেষ। মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল। বর্তমানে উৎস মুখটি ভরাট হওয়ায় পুরনো কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজধানী ঢাকা থেকে অল্প দূরত্বের শহর নারায়ণগঞ্জ। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর থাকায় শহরটির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা নদী বহুদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীটি সারা বছরই নৌ চলাচলের উপযোগী থাকে। কিন্তু এই নদীর পানি এখন এতটাই দূষিত যে, সেখানে জলজ প্রাণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা শীতলক্ষ্যার এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন এর শিল্প বর্জ্যকে। শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানার বর্জ্য এই দূষণের কারণ। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বাড়িঘরের তরল বর্জ্যও আসছে নদীতে। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকলে বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়বে নদীর তীর ঘেঁষে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। আর সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত হচ্ছে বিভিন্ন তরল বর্জ্য। নদী ও মানুষের জীবন যেন অবিচ্ছেদ্য। এ কথা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটু বেশিই সম্পর্কিত। দেশের মৃতপ্রায় নদী নিয়ে তাই প্রায়ই পরিবেশবাদীসহ সাধারণ মানুষের যত উদ্বেগ। তবে নদী রক্ষার তৎপরতা অবশ্য সারা বিশ্ব জুড়েই রয়েছে। তাই নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার পালন করা হয় বিশ্ব নদী দিবস। তবে ১৯৮০ সাল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস পালন করা হলেও বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে এ দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন এ উপলক্ষে কর্মসূচীও নিয়েছে।
×