ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে ১৩ চুক্তি সই হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে ১৩ চুক্তি সই হতে পারে

তৌহিদুর রহমান ॥ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফরকালে অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ। সে সময় দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো, সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এসব বিষয়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে ঢাকা-বেজিংয়ের মধ্যে তেরোটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য প্রস্তুতি চলছে। চীনা প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরকালে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনের জন্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ কার্যক্রমের উদ্বোধন হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আগামী ১৪ অক্টোবর দুই দিনের সফরে ঢাকা আসছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট পরদিন ১৫ অক্টোবর ঢাকা থেকে ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক সম্মেলনের উদ্দেশে রওনা দেবেন। চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের মধ্যে দিয়ে ঢাকা-বেজিং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও বাড়বে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফর সামনে ঢাকা-বেজিং এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত গত মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকও করেছেন। এসব বৈঠকে দুদেশের মধ্যে ১৩ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য আলোচনা হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে চট্টগ্রামের সীতাকু-ু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ ও উপকূল রক্ষা বাঁধ, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ, মংলা বন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি উন্নয়ন, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের প্রিপেইড মিটার প্রকল্প, ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ফোর লেনে উন্নীতকরণ, কর্ণফুলী তীরবর্তী স্যাটেলাইট টাউন গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ সফরের সময় কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করবেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চীনের সহযোগিতায় কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে দুই দেশের সঙ্গে একটি চুক্তিও হয়েছে। এই টানেলের দৈর্ঘ্য হবে তিন হাজার ৪০০ মিটার। এ বছর শুরু হয়ে ’২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে টানেল নির্মাণ শেষ হবে। টানেল নির্মাণে খরচ পড়বে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন দেবে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি খরচ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। টানেলের পশ্চিম পাশে ৭৪০ মিটার এবং পূর্ব পাশে ৪৫২ মিটার দৈর্ঘ্যরে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশ সফরকালে চট্টগ্রামে চীনা প্রেসিডেন্টের টানেল উদ্বোধনের বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে এই টানেল উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনের জন্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় এই বিনিয়োগ পার্ক কার্যক্রমের উদ্বোধন হবে। বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে সহযোগিতা দিতে চীন দীর্ঘদিন ধরেই আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। এ ইস্যুতে বাংলাদেশ এখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অবশ্য চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তৃতীয় কোন দেশকে যুক্ত করা হলেও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী দেশটি। সোনাদিয়ার পাশাপাশি পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও সরকারের আগ্রহ রয়েছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়েও চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনের প্রেসিডেন্টের আসন্ন সফরে গভীর সমুদ্রবন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে থাকছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সমুদ্র সম্পদ আহরণের বিষয়েও গুরুত্ব পাবে। বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সম্পদ আহরণে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। তবে সমুদ্র সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে কোন কোন সুবিধা চীনের কাছ থেকে নেয়া হবে, সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা প্রেসিডেন্টের সফর সামনে রেখে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রতিনিয়ত আলোচনা চলছে। কোন কোন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে দুই পক্ষ এখনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। তবে এখনও যথেষ্ট সময় আছে, চীনা প্রেসিডেন্ট আসার আগেই সকল বিষয় চূড়ান্ত হয়ে যাবে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতার বিষয়টিও রয়েছে। গত ২৮ মে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী চেং ওয়ানকুয়ান ঢাকা সফর করেন। এরপর আগস্টে বিষয়টিও নৌবাহিনী প্রধান এ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ চীন সফর করেছেন। সে সময় চীনের উচান শিপইয়ার্ডে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য দু’টি যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশে চীনের রফতানি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিবছর প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করে দেশটি। সে কারণে চীনে রফতানি বাড়ানোর জন্যে বাজার সুবিধাও প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। চীন আগামী ৫ বছরে বিদেশ থেকে ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করবে। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে উৎপাদিত পণ্য আমদানি করতে চায় চীন। এ প্রক্রিয়ায় চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি নিরসন করতে চায়। সে কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে দেশটি। এদিকে বাংলাদেশ ও চীন যৌথভাবে পঁচিশটি প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছে সহযোগিতা চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। চীনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ১২ প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ চাইছে এসব প্রকল্পে বাস্তবায়নে চীনের সহযোগিতা। চীনা প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসার আগেই এসব প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে চূড়ান্তে আগ্রহী বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে ঢাকা- বেজিং কূটনৈতিক সম্পর্কের চল্লিশ বছর পূর্তি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ৪০ বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক পূর্তি উপলক্ষে গত বছরই ঢাকায় আসার কথা ছিল চীনা প্রেসিডেন্টের। তবে বিভিন্ন কারণে এই সফর পিছিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আগামী ১৪ অক্টোবর তিনি ঢাকায় আসছেন। শি জিনপিং এর আগে ২০১০ সালে ঢাকা সফর করেছিলেন। তখন তিনি চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এদিকে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেন।
×