ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার ফাঁসির আদেশ ৩১ মাস আপীল বিভাগে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার ফাঁসির আদেশ ৩১ মাস আপীল বিভাগে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চাঞ্চল্যকর সেই দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় উচ্চ আদালতে আপীল নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে গত ৩১ মাসেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। দেশের ইতিহাসে এত বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র একসঙ্গে ধরা পড়ার ঘটনা একটি রেকর্ড হয়ে আছে। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায়ে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এসএম মজিবুর রহমান জামায়াত নেতা ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায়ে দ-িত) ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ফাঁসির রায় প্রদান করেন। এছাড়া খালাস পায় ৪১ জন। মামলা হওয়ার পর থেকে প্রায় দশ বছর পাঁচ বিচারকের হাত ঘুরে এ মামলার রায় ঘোষিত হয়। রায়ে মতিউর রহমান নিজামী ও লুৎফুজ্জামান বাবর ছাড়া আর যে ১২ জনকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয় তারা হলেন- ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নুরুল আমিন, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও আবদুর রহিম, সাবেক পরিচালক শাহাব উদ্দিন আহমেদ, সাবেক উপ-পরিচালক লিয়াকত হোসেন, সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের (সিইউএফএল) তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, এ অস্ত্রের চালানসহ বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালানি হাফিজুর রহমান ও দীন মোহাম্মদ এবং তাদের সহযোগী আবদুস সোবহান। এছাড়া খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মজিবুর রহমান, শেখ আহমদ, বশর মিয়া, বাদশা, কামাল মিয়া, মোঃ জসিম, মোঃ আক্তার, মোঃ আজিজ, মোঃ জাহাঙ্গীর, কবির আহমদ, মরিয়ম বেগম, মোঃ রফিক, আবদুল মালেক, মনির আহমদ, মঞ্জুরুল আলম, সাইফুদ্দিন, ফিরোজ আহমদ, এজাহার মিয়া, ফজল আহমদ, সালেহ জহুর, আকবর আলী, দিলদার হোসেন, সানোয়ার হোসেন, নুরুল আবসার, আবদুল মান্নান, ওসমান গনি, মোঃ সোবহান, শাহ আলম, শাহজাহান, আবদুস সবুর, বাবুল মিয়া, আবদুর রহিম মাঝী, হেলাল উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, প্রদীপ কুমার দাশ ও নুর নবী। বিচার চলাকালে আসামি মনির আহমদ, এয়াকুব আলী, আতাউর রহমান ও আবুল কাশেম মৃত্যুবরণ করায় তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে সাবেক দুই মন্ত্রীসহ ১৪ জনকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- দেয়ার ঘটনাটি ছিল নজিরবিহীন। এ রায়ের পর দ-িতদের সকলেই হাইকোর্টে এ আদেশের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপীল মামলা করেন, যে মামলা এখনও শুনানিতে আসেনি। ইতোমধ্যেই এ মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অন্যতম আসামি সাবেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত মৃত্যুদ- সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ হয়ে তা কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে অপর ১৩ জনের ফাঁসির রায় নিয়ে শুনানি হবে। সরকারপক্ষে আইনজীবীদের সূত্রে জানানো হয়েছে, আপীল শুনানির বিষয়টি চলছে ঢিমেতালে, যে কারণে ইতোমধ্যে রায়ের পর আরও ৩১টি মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর আগে বিচার সম্পন্ন হতে সময় লেগেছে প্রায় দশ বছর। একটি চাঞ্চল্যকর মামলা ও এর রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে কেন এ বিলম্ব তা তাদের বোধগম্য নয়। বিশেষ বিবেচনায় উচ্চ আদালত এ মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নিলে তা দ্রুত কার্যকর করা যাবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন। এদিকে, মালয়েশিয়ায় গ্রেফতার বাংলাদেশী নাগরিক আন্দালিব আহমেদকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার পর তাকে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি পেয়ার আহমদ আকাশ বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি সূত্রে শনিবার জনকণ্ঠকে জানানো হয়, দুটি ট্রলার বোঝাই হয়ে আসা পরবর্তীতে দশ ট্রাকযোগে পুলিশী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা এ অস্ত্রের চালান থেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল খোয়া যায় বলে অভিযোগ ওঠার পর সিএমপির দুই সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ও হেলালকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার এক বছর পর দুটি একে-৪৭ রাইফেল র‌্যাব সেভেন ফেনী ও নোয়াখালী থেকে উদ্ধার করে। একটি উদ্ধার করা হয় ফেনীর পেয়ার আহমদ আকাশের হেফাজত থেকে এবং অপরটি উদ্ধার হয় নোয়াখালীর দাগনভূঞার দুলাল খন্দকারের বাসা থেকে। এরা দু’জনই গ্রেফতার হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। এখন মালয়েশিয়ায় গ্রেফতারকৃত এবং বাংলাদেশে প্রেরিত আকাশ ফেনীর জেলে রয়েছে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। অপরদিকে সিআইডি সূত্র জানায়, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার চালান থেকে কোন অস্ত্র খোঁয়া যায়নি। র‌্যাব যে দুটি একে-৪৭ ফেনী ও নোয়াখালী থেকে উদ্ধার করেছে সেগুলো ভিন্ন অস্ত্র। দুই সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ও হেলালের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আদালত বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। উল্লেখ্য, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য প্রেরিত অস্ত্রের এ ভারি চালান সমুদ্রপথে চট্টগ্রামের বহিঃনোঙরে খালাস হওয়ার পর দুই ট্রলার বোঝাই হয়ে সিইউএফএল জেটিতে খালাস হওয়ার সময় সার্জেন্ট হেলালের সঙ্গে চোরাচালান দলের সদস্যদের বাগ্বিত-ার জের হিসেবে তা চাউর হয়ে ধরা পড়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে এ মামলা অনেকটা হিমাগারে চলে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আমলে এ মামলা তদন্তে গতি পায়। শেষ পর্যন্ত চার্জশীট দেয়ার পর বিচার শুরু হয়। বিচারে উপরোক্ত ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ইতোমধ্যেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অনেকের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। এক্ষেত্রেও আপীল সর্বোচ্চ আদালত ঘুরে রিভিউ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় উচ্চ আদালতে শুনানির জন্য কজ লিস্টেই দিন গুনছে।
×