ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ গোপাল দত্ত

মনোযোগের অভাব এবং হঠাৎ রেগে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মনোযোগের অভাব এবং হঠাৎ রেগে যাওয়া

২০১১ সালের ২৫ জুলাই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে পাগল হিসেবে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কিন্তু বেড়ে গেছে অঝউ অর্থাৎ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের রোগীর সংখ্যা। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার অনেক সমন্বিত রোগের লক্ষণ এবং রোগীর লক্ষণ ভিন্নতর। এদের মধ্যে একটি হলো অউঐউ (অঃঃবহঃরড়হ উবভরপরঃ ঐুঢ়বৎধপঃরারঃু উরংড়ৎফবৎ). বলছিলাম পাগলের সংখ্যা কমে গেছে। আসলে আগে অটিস্টিক বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের সব রোগীকেও পাগল বলে চিহ্নিত করা হতো। জনসচেতনতা, রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা, রোগ নির্ণয়ে দক্ষতা, সর্বোপরি মানুষের শিক্ষার অগ্রগতি সব মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের রোগীরা যে পাগল নয় তা সম্পূর্ণভাবে আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মানুষের ব্যবহার, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, বিভিন্ন রোগের প্রভাবে বিভিন্ন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ, যেমন বস্ত্র ত্যাগ করা, পানিতে ডুবে থাকে, খাবার ছিটিয়ে ফেলে দেয়া, ক্ষুধার্ত না হওয়া অথবা মেটাবলিক ডিজঅর্ডারের জন্য বিভিন্ন রকম অসংলগ্ন আচরণ করলেই বলা হতো তাকে জিনে ধরেছে বা সে পাগল হয়ে গেছে। বর্তমানে অবশ্য মানুষের মন থেকে জিন চিন্তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হুজুরদের জিন চালান, বাটি চালানে উপার্জন কমে গেছে। সোজা কথা ঐ ব্যবসাও বিলুপ্তির পথে। কিন্তু প্রতারকদের দ্বারা চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও প্রতারিত হচ্ছে। বলছিলাম অউঐউ এর কথা। আমরা জানি অটিস্টিক শিশুরা একে অন্যের মতো হয় না। একেকজন একটি স্বতন্ত্র গুণের অধিকারী হয় এবং একেকজনের মধ্যে একেক ধরনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। ইদানীং অউঐউ অর্থাৎ মনোযোগের অভাবসহ হঠাৎ রেগে যাওয়া রোগীর সংখ্যা রোগ নিরূপণের জ্ঞানের জন্য অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের তিনটি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ জঊঅঈঐ (জবংঢ়ড়হংব, ঊধৎষু ওহঃবৎাবহঃরড়হ, অংংবংংসবহঃ রহ ঈড়সসঁহরঃু ঐবধষঃয) ওগঐ (ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ গবহঃধষ ঐবধষঃয) এবং ঘটঐ (ঘধঃরড়হধষ টহরাবৎংরঃু ঐড়ংঢ়রঃধষ) প্রত্যেকেই নতুন নতুন অউঐউ এর রোগী শনাক্ত করে চলেছে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের সাইকোলজিক্যাল মেডিসিনের ঔড়যহ ডড়হম-এর পরিসংখ্যানে বা চাঁদের মধ্যে ৫-৮% এবং বড়দের মধ্যে ২-৩% এই রোগে ভুগে থাকেন। অউঐউ একটা ¯œায়ুবিকাশজনিত সমস্যা যা যেসব ব্যক্তির অহীরবঃু বা দুশ্চিন্তা এবং ষবধৎহরহম ফরভভরপঁষঃরবং অর্থাৎ লেখাপড়া মুখস্থ করা বা মনে রাখতে অপারগতা থাকে, তাদেরই বেশি হয়ে থাকে। স্কুলগামী ছাত্রদের মধ্যে এটা হলো একটা সর্বোচ্চ মানসিক সমস্যা যা ৬ বছর বয়স থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যেই তিনটি দিকের বিশেষ উত্তেজনা তাদের মধ্যে দেখা যায় তা হলো আবেগপ্রবণতা (বসড়ঃরড়হধষ), বন্ধুত্ব বা সামাজিকতায় দুর্বল (ঝড়পরধষরুধঃরড়হ) এবং হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া (নবযধারড়ৎধষ রংংঁবং) বা কেঁদে ফেলা। এসব বাচ্চার কেউ কেউ বলে ফেলেন, ‘আমি দুষ্টু নই, আমার নিজের ওপর আমার কিছু নিয়ন্ত্রণ নেই, আমার ব্রেইন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘আমি আবেগপ্রবণ’। কেউ কেউ বলেন, ‘মা-বাবা, শিক্ষক-আত্মীয় কেউ আমার মনের কথা বুঝতে পারে না বা চাহিদা মিটিয়ে দিতে চায় না। আমি কিন্তু অন্যদের মতো মূল্যবান কিছুই চাই না।’ যখন অসুখটি সঠিকভাবে নিরূপিত হয় তখন শিক্ষক এবং পিতা-মাতার উচিত হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করা এবং মেনে নেয়া যে শিশুটির আচার বা ব্যবহারের যে অসামঞ্জস্য, দুর্বলতা বা অসংলগ্নতা তার ইচ্ছাকৃত নয় এবং স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কোন কোন শিশু মনস্তত্ত্ববিদের মতে এসব বাচ্চারা ফরংড়ৎমধহরুবফ (অগোছালো) ঘন ঘন ভুলে যায় (ভড়ৎমবঃভঁষ) এবং শিক্ষকদের অনেক আদেশ এবং নির্দেশ মানতে পারে না এবং মানসিকভাবে মানতে বাধ্য থাকে না। তাদের ব্যবহার (ওসঢ়ঁষংরাব) এবং আচরণ সংযতহীন। এই অউঐউ রোগীরা সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে ওহধঃঃবহঃরাব (অমনোযোগী), ঐুঢ়বৎধপঃরাব– (অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক আচরণ), ওসঢ়ঁষংরাব- আবেগপ্রবণ অথবা এই দুয়ের সংমিশ্রণ।) এ পর্যন্ত গবেষণায় যা পাওয়া গেছে এতে দেখা গেছে মস্তিষ্কের যেই অংশটুকু মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে (ধঃঃবহঃরড়হ পড়হঃৎড়ষ) এবং আচরণবিধিকে সংযত রাখে সেই অংশটুকুর পরিপক্বতা লাভে বিলম্বিত হয়। এদের মধ্যে যারা অমনোযোগী কিন্তু উদ্ধত আচরণ করে না। তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভা লুকায়িত থাকে। এ ধরনের বাচ্চাদের খুব ভালভাবেই চিকিৎসা করা যায়। সেক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের ওষুধের প্রয়োজন হয় না। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং আচার ব্যবহারের সুস্পষ্ট এবং সঠিক থেরাপী বা চিকিৎসাই যথেষ্ট। (ইবযধারড়ৎধষ ঃযবৎধঢ়ু ্ ঊহারৎড়হসবহঃধষ ধফলঁংঃসবহঃ). পরিবেশের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর অর্থ হলো তাদেরকে সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে সাহায্য করা, শিক্ষকের পাশে প্রথম সারিতে বসতে দেয়া, জানালা এবং দরজার কাছে থেকে দূরে রাখা অথবা তার পাশের জানালা ও দরজা বন্ধ করে দেয়া। অধিকতর যতœ এবং মনোযোগ আকর্ষণ করানো অথবা যে কাজের প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক আছে, সেদিকে তাকে একাগ্রচিত্তে কাজ করা বা মনোনিবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। চিকিৎসক ও পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা তাদেরকে ভুল পথে বা ডিপ্রেশন, অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং আসক্তি থেকে দূরে রাখতে পারে। আমি ছাত্ররাজনীতির সুবাদে আমার এক রাজনৈতিক নেতাকে চিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরায় উনার সঙ্গে আরও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, উনাকে দেখেছি হঠাৎ করে রেগে যেতেন, হাতে যা কিছুই থাকত ছুড়ে ফেলে দিতেন, এমনকি কাগজের টাকা হাতে থাকলে ছিড়ে ফেলতেন। পরে ছাত্র রাজনীতিতে উনি ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় রাজনীতিতে অনেক ভূমিকা রেখেছেন। উনার আচরণ এখন যদি বিবেচনা করি তাহলে মনে হয় উনিও অউঐউ এর লক্ষণ সমন্বিত একজন রাজনৈতিক নেতা। কিছুদিন আগে তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা দেশটা ধ্বংস করেছি, তোমরা ডাক্তাররা চিকিৎসা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছ।’ বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অউঐউ এর লক্ষণগুলো অনেক কমে যায় এবং জীবনের শেষ দিকে উনারা একজন সাফল্যম-িত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। এই রোগ নির্ণয়ের পরে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সহানুভূতিশীল এবং বাস্তববাদী হতে হবে এবং বুঝতে হবে রোগীর আচরণ ইচ্ছাকৃত এবং স্বতঃস্ফূর্ত নয়। সবচেয়ে সুখবর হলো অউঐউ রোগীদের অনেকেই সার্বিক যতœ পেলে লেখা পড়াসহ, যে কোন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হলে, তারা মহৎ কিছু অর্জন করে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে। আমেরিকান সাঁতারু মাইকেল ফেলপস অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পদক জয়ের যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তিনিও একজন অউঐউ আক্রান্ত দেবশিশু (এরভঃবফ পযরষফ) (সূত্র : ঞযব ংঃৎধরমযঃ ঃরসবং, ঔঁষু ১২, ২০১৬) ২০১৬-এর রিও অলিম্পিকে আমেরিকান জিমন্যাস্ট সাইমন বিলসকে রাশিয়ান হ্যাকার কর্তৃক এনাবলিক ড্রাগ নেবার যে তথ্য দিয়েছে ওয়ার্ল্ড এন্টি ডেপিং এজেন্সি (ডঅউঅ) একে শুধু অনৈতিক বলে আখ্যায়িত করেনি বরং একজন এ্যাথলেটের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গোপনীয়তা ভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত করেছে। আসলে ইওখঊঝ একজন অউঐউ এর রোগী যার জন্য সে শুধু জরঃধষরহ গ্রহণ করত দীর্ঘদিন ধরে। সেও ৪টি পদক জয় করে প্রমাণ করেছে অউঐউ আক্রান্ত শিশু, যুবক এবং যুবতীরা পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে অনেক উচ্চতায় আরোহণ করতে পারে। আমার কথা ‘অটিজম নিয়ে আমাদের শুরু সবার শেষে। ২৫ জুলাই, ২০১১ থেকে অদ্যাবধি আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। এই শিশুরা আমাদের স্বপ্ন ও সন্তান। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। হয়ত, তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একজন আইনস্টাইন। তারা কোথায় যেন একটু খাটো, অপারগ। দেহ-মন এবং মস্তিষ্কে তেমন শক্তপোক্ত নয়। বহুজনের ভালবাসার কল্যাণ স্পর্শ একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু তাদের যদি না চিনি, না জানি, তাহলে কি করে ভালবাসব, পরিচর্যার হাত বাড়িয়ে দেব। এখানেই আরও বেশি জরুরী ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে তাকে এবং তার পরিবারকে আরও কাছে টেনে আনার। তাহলেই সবাই বিনা সুতোর মালায় গাঁথা থাকব।’ লেখক : সাবেক ভিসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×