ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

নতুন দিনের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নতুন দিনের স্বপ্ন

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাহার মাথায় একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক দিন ধরে। সে যখন চোখে দেখত তখন ফেসবুক ব্যবহার করত। এখন পারে না। এমনটি ভাবতে গেলেই তার কান্না পায়। নীরবে কাঁদে। সড়ক দুর্ঘটনায় জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেল। মা মারা গেল। আর সে হারাল দৃষ্টি শক্তি। এই সময় বাবা এসে ঘরে ঢোকে। বাবার পায়ের আওয়াজ পেয়ে মাহা চোখের পানি মুছে ফেলে। সে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কিছু ভাবছে। গভীর ভাবনা। আসলে সে মনের কষ্ট বাবাকে বুঝতে দেয় না। বাবা কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, মা, কী করছ? কিছু করছি না। কী ভাবছ? কিছু ভাবছি না। আজকে কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে তোমার? না। ইচ্ছে করছে না। আমি আজকে বাসাতেই থাকব। চলো আজকে তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে ঘুরতে যাই। না বাবা। আজকে ঘুরতে ইচ্ছে করছে না। আজ ছুটির দিন বাসায় বসে থেকে কী করবে? অনেক কাজ আমার। জানো ভাবা, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। চমৎকার আইডিয়া। কী আইডিয়া? দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ফেসবুক তৈরি করব। তার মানে? তার মানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যাতে ফেসবুক ব্যবহার করতে সেরকম একটা পদ্ধতির উদ্ভাবন করা। কী করে সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। সহজ। তুমি বিজ্ঞানী কান্টিবান্টিকে বাসায় আনার ব্যবস্থা করো। বাবা ড্রাইভারকে ফোন করে বলে, বিজ্ঞানী কান্টিবান্টিকে এক ঘণ্টার মধ্যে পাকড়াও করে বাসায় নিয়ে এসো। বাবার কথা শুনে মাহা হাসে। এত বড় একজন বিজ্ঞানীকে ধরে আনতে হয়। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ছোটে। বিজ্ঞানী কান্টিবান্টিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেসের বিরাট তালা। ড্রাইভার ফোন করে, বিজ্ঞানী সাব, আফনে কোনহানে? আমি পুরান ঢাকায়। হাজির বিরিয়ানি খেতে এসেছি। আফনে ওইহানে থাহেন। আপনাকে পাকড়াও করতে হবে। কেন? আমাকে পাকড়াও করতে হবে কেন? কারণ, সাহেবের হুকুম। ড্রাইভার ফোন কেটে দিয়েই গাড়ি হাঁকায়। এদিকে কান্টিবান্টি বাড়তি কাজের চাপ মনে করে সে হাজির বিরিয়ানি খাওয়া রেখেই পালায়। রিকশা নিয়ে গুলিস্তানের দিকে যায়। এই সময় ড্রাইভার বিপরীত দিক থেকে আসছিল। কান্টিবান্টিকে দেখে গাড়ি পার্ক করেই কান্টিবান্টিকে রিকশা থেকে নামায়। তারপর গাড়িতে তুলেই চম্পট। বাসার দিকে। ড্রয়িং রুমে বসে আছে মাহা। বসে আছে মাহার বাবা। কান্টিবান্টির পরনে লাল প্যান্ট। গায়ে গোলাপি টিশার্ট। মাথায় চার্লি চ্যাপলির ক্যাপ। চোখে কালো গগলস। পোশাক দেখে মাহার বাবার পেটের ভিতরে হাসির ঢেউ ওঠে। অনেক কষ্টে সামলান। তারপর বলেন, বসো কান্টিবান্টি। মাহার কথা মতো তোমাকে একটি কাজ করে দিতে হবে। কী কাজ করে দিতে হবে? তুমি তার কাছ থেকেই শুনো। আগে চা খাও। বিশ্রাম নাও। তারপর কাজ। কাজ শেষ না করা পর্যন্ত এখানেই থাকবে। কথা শেষ করে মাহার বাবা ওঠে যান। আতিকন কাজের বুয়া চা-নাশতা দেয়। চা-নাশতা খেয়ে কান্টিবান্টি বলল, মাহা বলো, এখন কী করতে হবে। হুকুম করো। মাহা বলল, এমন একটা ফেসবুক বানাবেন যাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ব্যবহার করতে পারে। এটা সম্ভব নয় মাহা। তোমার মাথায় সব আজগুবি ভাবনা। চোখে দেখতে পারো না বলেই এসব আজগুবি ভাবতে পার। চোখে দেখতে পেলে অন্য কাজে করতে পারতে। কান্টিবান্টির কথা শুনে কষ্টে মাহার বুক ফেটে যায়। সে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। কান্টিবান্টিও বুঝতে পারেনি মাহা কাঁদবে। এমন কথায় কান্নার কী আছে, কান্টিবান্টির মাথায় খেলে না। তবে মাহার কান্না দেখে সেও কষ্ট অনুভব করে। আর ভয়ও পায়, যদি মাহার বাবা জানতে পারেন তাহলে পিঁপড়াডলা খাওয়ার আশঙ্কা আছে। তার এতো আদরের মেয়েকে কাঁদানো সহজ কথা নয়। কান্টিবান্টি দুঃখিত বলে মাফ চায়। মাহার মনও স্বাভাবিক হয়। সে বুঝতে পারে, এ ধরনের কথা তার জীবনে প্রাপ্য। আরও শুনেছে। আরও শুনবে। এ নিয়ে কাঁদা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। পরিস্থিতি দু’জনেই সামলে নিয়ে কাজের কথায় ফিরে আসে। মাহা বলল, আমি ধারণা দিচ্ছি, আর আপনি ফেসবুকের প্রোগ্রামিং করেন। বিজ্ঞানী কান্টিবান্টি নোটবুকে লিখে। মাহা বলে যায়, আপনি জানেন আমরা ব্রেইলে লেখাপড়া করি। হাতের স্পর্শে লেখা বুঝতে পারি। এখন আপনার প্রথম কাজ হলো কীবোর্ডটি তৈরি করা। আপনি ধোলাই খালে ইঞ্জিনিয়ার ঘুট্টুসের সাহায্য নিবেন। বাবার কাছে ওর ঠিকানা আছে। তারপর কীবোর্ড এমনভাবে তৈরি করবেন যাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা হাত দিয়ে বুঝতে পারি কীবোর্ডের কোনটি কোন হরফ। বুঝলেন? বুঝলাম। তারপর? তারপর কারসরের সঙ্গে শব্দের সংযোগ ঘটাতে হবে। আমার যখন দৃষ্টিশক্তি ছিল তখনকার স্মৃতি থেকে বলছি। ধরেন, টুলবারে যেখানে যা লেখা আছে কারসর সেখানে গেলেই সেটি শব্দের কোডে প্রকাশ করবে। যেমন ধরেন, আমি অনুমান করে কারসর উপরের দিকে নিলাম। কারসর হোম মেন্যুতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাইল শব্দটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চারিত হবে। অনুরূপভাবে, ইনসার্ট, পেজ লেআউট, রেফারেন্সেস, মেইলিংস, রিভিউ, ভিউ, অ্যাডস-ইন ইত্যাদি। এভাবে প্রত্যেকটি মেন্যুতে যাওয়ার পরই কম্পিউটারে যাতে সঠিক উচ্চারণে শব্দ হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ কম্পিউটারের স্ক্রিনটা হবে ‘রিডিং স্ক্রিন’। কি, খুব সহজ না? হ্যাঁ। খুব সহজ। এই সহজ ধারণাটি আমার মাথায় কেন এলো তাই ভাবছি। তাহলে তো আমি বিখ্যাত হয়ে যেতাম। আপনিই তো বানাচ্ছেন। তাহলে বিখ্যাত হওয়ার বাকি কই? না। এটি তোমার ধারণা। আমি কেবল তোমার বুদ্ধি নিয়ে কাজ করছি। কামলা। মাহা হাসে। কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে যায়। তারপর মাহা বলল, তাহলে ফেসবুক কীভাবে হতে পারে? কান্টিবান্টি বলল, খুব সোজা। একটা রিডিং স্ক্রিন তৈরি করলেই হলো। চমৎকার। আপনার জ্ঞান সত্যি গভীর। আমি মুগ্ধ। তুমিও আমার চেয়ে বড় বিজ্ঞানী। আমিও মুগ্ধ। আমাকে এক মাস সময় দাও। রিডিং স্ক্রিনের কম্পিউটার তৈরি করে দিচ্ছি। শুধু ফেসবুক নয়। কম্পিটারের সবই তুমি ব্যবহার করতে পারবে। এখন আসি। কান্টিবান্টি উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। সে রুম থেকে বের হয়ে যায়। মাহা আস্তে আস্তে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিরঝিরে সুন্দর বাতাস বইছে। বাইরে হয়ত চমৎকার আলো। মাহা তা দেখতে পায় না বটে, তবে সে মনের চোখ দিয়ে দেখতে পায় নতুন দুনিয়া। নতুন দিনের স্বপ্নে তার চোখ ভরে ওঠে।
×