ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গুণীশিল্পী চুনু ॥ সঙ্গীতেই প্রেম যার

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

গুণীশিল্পী চুনু ॥ সঙ্গীতেই  প্রেম যার

সৃজনশীল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সঙ্গীত অন্যতম। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি অনুসারে গানের অনেকগুলো ধারা রয়েছে। এ সকল ধারাকে সমৃদ্ধ করতে সাধনা করেছে অসংখ্য শিল্পী। তাদের অনেকেই মেধা, মনন, সৃজনশীলতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে শ্রোতার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সঙ্গীত জগতের তারকা হয়েছে। পেয়েছে বিত্ত, বৈভব, খ্যাতি ও প্রতিপত্তি। কিন্তু প্রান্তিক সঙ্গীতশিল্পীদের অনেকেই সঙ্গীতকে ভালবেসে, সারাজীবন সাধনা করেও নানা কারণে অবহেলিত থেকেছে। হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। তেমনি এক অবহেলিত গুণী সঙ্গীতশিল্পী রংপুরের সাইফুর রহমান চুনু। ভক্ত ও পরিচিতজনরা তাকে চুনু ভাই বলে ডাকে। চুনু ভাইয়ের বয়স এখন ৬০। রংপুর হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে গানের ভুবনে তার নিত্য বসবাস। সঙ্গীতের নেশায় এমনই বুঁদ হয়ে ছিলেন যে, কখন বিয়ের বয়স পেরিয়ে বার্ধক্যে এসে পড়েছেন টেরই পাননি। ফলে বিয়ে আর করা হয়নি। সংসার বিরাগী এ মানুষটি কখনও অর্থ-বিত্তের পেছনে ছোটেননি। সারাক্ষণ মেতে থাকেন তবলা-হারমোনিয়াম নিয়ে। এতে ঠিকমতো সংসার চলে না। অভাব তার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তাতে কি? চুনু ভাইয়ের দুঃখ নেই। নেই কোন চাওয়া-পাওয়া। সঙ্গীতেই তার সুখ, সঙ্গীতেই ভালবাসা। কেন, কিভাবে সঙ্গীতের প্রেমে পড়লেন, কি পেলেন এ থেকে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, প্রেমে পড়েছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমিতো গান ছাড়া আর কিছুই করিনি। অন্যকিছু করার কথা ভাবিনি, অন্যকিছু শিখিওনি। প্রেম ছাড়া কি এতকাল সঙ্গীতচর্চা করা যায়? তবে সঙ্গীত সাধনা করে শুধু মনের আনন্দ ছাড়া আর কিছু পাইনি। এদেশের মানুষ গান শুনতে ভালবাসে। কিন্তু শিল্পীর মূল্যায়ন করতে জানে না। সম্মান দিতে জানে না। শিল্পীরাও যে মানুষ, তাদেরও যে খেতে পরতে হয়, এটা কেউ ভাবে না। আমাদের মতো শিল্পীরা এদেশে সত্যিই অবহেলিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রে তিন মাসে একবার মাত্র ডাক পড়ে। প্রতিটি প্রোগ্রামে পাই মাত্র ৪৪০ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন জেলা-উপজেলা বা রংপুর শহরে কিছু কিছু প্রোগামে গান গেয়ে কিছু সম্মানী পাই। দু’একজনকে গান শেখাই। তা দিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে বৃদ্ধা মা আর আমি- দু’জনের সংসার চলে। আগে প্রোগ্রামগুলোতে বেশ ভাল সম্মানী দিত। এখন তাও দিতে চায় না। তবে রংপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সাউন্ড টাচ’ প্রোগাম পাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। তিনি বলেন, আমার কাছে অনেকেই গান শিখতে আসে। কিন্তু আমি সবাইকে শেখাই না। সঙ্গীত বড়ই আবেগের জিনিস। এটা যার-তার জন্য নয়। অনেকেই গান শিখতে চায় সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অথবা নিছক ফ্যাশন হিসেবে। গানের প্রতি যাদের মনের টান নেই, শ্রদ্ধা নেই, তাদের গান শেখানোকে আমি প্রতারণা মনে করি। তাছাড়া ভালভাবে গান না শিখে গান গাইলে গানের অমর্যাদা হয়। শিশুকাল থেকেই গানের সুর চুনুর মর্মস্পর্শ। তবে পিতৃকুল বা মাতৃকুল কোন কুলেরই কেউ সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন না। বরং বাড়ির পরিবেশ ছিল সঙ্গীতবিরোধী। বাবা মোকলেছুর রহমান রংপুরের জেলা প্রসাশকের নাজির থাকার কারণে মেডিক্যাল স্টাফ কোয়ার্টারে ছিল চুনুর পরিবার। চুনুর বাবা চাইতেন ছেলে সারাক্ষণ পড়ুক। চুনুর মন পড়ে থাকে গানের দিকে। পাশের ফ্লাটের বন্ধু মানু ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন। মানু গান শিখতেন ঘরের ভেতরে, আর চুনু জানালার ধারে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তা শুনতেন। তারপর ওস্তাদ চলে গেলে মানুর সঙ্গে রেওয়াজ করতেন। এভাবেই শুরু হয় চুনুর ওস্তাদবিহীন সঙ্গীত শিক্ষা। একপর্যায়ে বন্ধু মানুর উৎসাহে এক বছরের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে চুনু ৬৫ টাকা দিয়ে হারমোনিয়াম কেনেন। চুনু বলেন, হারমোনিয়াম কেনার পর কি যে বিশ্বজয় করা আনন্দ পেয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। কিন্তু বাড়িতে হারমোনিয়াম রাখা বিপজ্জনক। বাধ্য হয়ে ছাদের চিলেকোঠায় ছেঁড়াকাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে লুকিয়ে রাখা হতো। আর সময়-সুযোগ মতো বাড়ির লোকদের অলক্ষ্যে সেখানে চলত সঙ্গীতচর্চা। ১৯৭২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় রংপুর টাউন হল মঞ্চে মহুকুমা ও জেলা পর্যায়ে নজরুলসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় চুনু দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া তিন জেলার প্রতিযোগিতায়ও চুনু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তাঁর অসাধারণ গানের প্রতিভা সকলকে বিস্মিত করে। তাঁর এ সাফল্যে রংপুর বেতার তাঁকে নিয়মিত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিয়োগ দেয়। চুনুর সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার। রংপুর সরকারী কলেজে এইচএসসি পড়ার সময় সঙ্গীত নিয়ে বাবার সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে রাগ করে বাড়ি ছাড়েন চুনু। বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে আসেন। এই সময়ে বিভিন্ন স্থানে গানের দলের সঙ্গে ভবঘুরে জীবনযাপন করেছেন। বর্তমানে রংপুর বেতারে অনিয়মিতভাবে গান করেন। আগ্রহী উদ্যোক্তা পেলে রংপুরে ভাল মানের সঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে চান তিনি। দুঃখ করে বলেন, সবাই সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়, কেউ ভাল শিল্পী বানাতে চায় না। তাই গুণী শিল্পী কম তৈরি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এখন সবার দৃষ্টি ঢাকামুখী। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে আজকাল লাইম লাইটে আসা যায় না। লাইম লাইটে না এলে ভাল শিল্পীও হওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, প্রান্তিক পর্যায়ে প্রচুর মেধাবী ও সম্ভাবনাময় শিল্পী আছে। তারা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। তাদের বিকাশের পথে অনেক বাধা। তাদের খুঁজে বের করে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মতো তারা কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। তার প্রিয়শিল্পী আবদুল জব্বার, নিলুফার ইয়াসমিন, মানবেন্দ্র এবং রংপুরের জিয়াউল হক লিপু। Ñআবদুর রউফ সরকার রংপুর থেকে
×