ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোতাহার হোসেন

অবশেষে ধরিত্রী রক্ষায় মোড়লদের বোধোদয়

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অবশেষে ধরিত্রী রক্ষায় মোড়লদের বোধোদয়

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি, বাতাসে ক্রমাগত কার্বন ড্রাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণে মূলত বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে ভূ-ম-লের, ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে, হিমালয় পর্বতসহ পৃথিবীর সুউচ্চ পর্বতসমূহের বরফ গলে সমুদ্রে আসছে পলিমাটি সমেত। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এ কারণে দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা, উপজেলার হাজার হাজার গ্রাম, ফসলী জমি, পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক জোয়ারে। একই সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রের লবণাক্ততা। আর এ জন্য দায়ী অধিক মাত্রায় ভোগবাদী, শিল্প উন্নত, ধনী রাষ্ট্রসমূহ। এ মুহূর্তে যুদ্ধ, সন্ত্রাস যেমনি করে মানব জাতির জন্য, মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ এবং সন্ত্রাস ক্ষতি করে দৃশ্যমান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিক ক্ষতি হয় ধীরে ধীরে এবং অনেকটা অদৃশ্যমান। এসব কারণে উদ্বিগ্ন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। তেমনি হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বিষয়টিও। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ইউরোপের কিছু দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশসহ বেশকিছু ধনী রাষ্ট্র। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার বাংলাদেশসহ কতিপয় স্বল্পোন্নত দেশ। বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরে যে হারে প্রকৃতির বৈরী অবস্থা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখে পড়েছে তা একদিকে উদ্বেগের, অন্যদিকে আতঙ্কের। এর জ্বলন্ত প্রমাণ ২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সংঘটিত সর্বনাশা ‘আইলা, সিডর, পরবর্তীতে হারিকেন’ এর তা-বে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ঐ অঞ্চলের মানুষ। প্রসঙ্গত: জলবায়ু ক্ষতি থেকে বিশ্ব ধরিত্রিকে রক্ষায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে গত ১৭/১৮ বছর ধরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।’ বিশ্বের সকল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের ১৮০টি সদস্য রাষ্ট্রকে নিয়ে প্রতি বছর নবেম্বরের শেষ অথবা ডিসেম্বরের শুরুতে টানা ১০ থেকে ১২ দিনব্যাপী বৈঠক করেন। বৈঠকে কার্বন কমানো, এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় আর্থিক, কারিগরি, প্রযুক্তিগত সহায়তা শর্তহীনভাবে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা মানা হয় না। এমনি এক অনিশ্চয়তার মধ্যে সম্প্রতি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তিতে অনুসমর্থন দিয়েছে বিশ্বের ৪০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দুই দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। চীনের শহর হাংচৌতে এক অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের হাতে অনুসমর্থনের দলিল তুলে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী দুই দেশের এই চুক্তিতে অনুসমর্থনকে পরিবেশ বিপর্ষয় রোধে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি পুষিয়ে আনতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখছেন বিশ্ববাসী। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যৌথভাবে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে সমর্থনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী ‘ধরিত্রী রক্ষায়’ নতুন করে আশার আলো দেখছেন। বিশ্বের ১৮০টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মূল লক্ষ্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা দেয়া। গত বছরের ডিসেম্বরে ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় হার দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে বা সম্ভব হলে দেড় ডিগ্রীর মধ্যে রাখতে বিশ্বের দেশগুলো একমত হয়। প্যারিস চুক্তি হচ্ছে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক প্রথম সমন্বিত চুক্তি। তবে এটি তখনই কার্যকর হবে, যখন মোট কার্বন নিঃসরণের ৫৫ শতাংশের জন্য দায়ী ৫৫টি দেশ চুক্তিতে অনুসমর্থন করবে। এ পর্যন্ত ২৪টি দেশ এ চুক্তি অনুসমর্থন করেছে। এর মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপদেশের পাশাপাশি শিল্পোন্নত দেশ ফ্রান্সও আছে। কার্বন নিঃসরণে ওই দ্বীপদেশগুলোর অবদান সামান্য হলেও তারা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘আশা করছি, এ বছরের শেষ দিক থেকেই প্যারিস চুক্তি কার্যকর হবে।’ অন্যান্য দেশকে এ চুক্তিতে সম্মত করার বিষয়ে এ মাসের শেষ দিকে নিউইয়র্কে এক বিশেষ বৈঠক হবে। বৃহৎ দুই দেশের এই চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে উল্লেখ করেন তিনি। বান কি মুনের হাতে অনুসমর্থনের দলিল তুলে দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘এই ধরিত্রীকে রক্ষার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই চুক্তি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, এই চুক্তি একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ঘটিয়েছে। এদিকে, চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই চীনের পার্লামেন্টে প্যারিস চুক্তি অনুসমর্থনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অনুসমর্থনের পর শি জিনপিং বলেন, ‘চীন এই চুক্তির বাস্তবায়নে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের অনুসমর্থনের পর অন্যরাও এতে উৎসাহিত হবে বলে আশা করছি।’ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং এর ফলে সংঘটিত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত আবহমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পুঞ্জীভূত হওয়াকে দায়ী করা হয়। উঠতি শিল্পোন্নত রাষ্ট্র চীন বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ কার্বন নিঃসরণকারী। আর দ্বিতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। তাই প্যারিস চুক্তিতে এই দুই দেশের অনুসমর্থন খুবই তাৎপর্যবহ। প্যারিস চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চীন ২০৩০ সালের মধ্যে ২০০৫ সালের তুলনায় দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রতি এককে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ রোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া তারা অজীবাশ্ম উৎস থেকে ২০ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের অনুসমর্থনকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির এই সমর্থনে জানান দিচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে এবার সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক তৎপরতা শুরু হবে। চুক্তিতে অনুসমর্থনকে তাই একটি যাত্রা শুরু বলা যেতে পারে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এটি চূড়ান্ত কোন পদক্ষেপ নয়। বিশ্ব জলবায়ু চুক্তিকে এবার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিল কার্বন নিঃসরণকারী শীর্ষ দুই দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের কমপক্ষে ৫৫টি দেশ অনুমোদন দেয়ার ৩০ দিন পর প্যারিস চুক্তিটি বাস্তবায়ন শুরু হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশের তহবিল প্রাপ্তির ওপর নির্ভর না করে নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব মোকাবেলার জন্য ২০০৯ সালে প্রণয়নকৃত ১০ (দশ) বছর মেয়াদী বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী প্রজ্ঞা, স্বদেশ প্রেমের অনন্য উদাহরণ, যে সীমিত সম্পদ থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নীরব ঘাতকের হাত থেকে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে পরিত্রাণ দিতে নিয়েছেন ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা। পরবর্তীতে তাঁর এই মহতী উদ্যোগ বিশ্বের দেশে দেশে এমনকি জাতিসংঘে প্রশংসিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যম্পিয়নস অব দ্য আর্থ-২০১৫’ প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, সরকারের রাজস্ব বাজেট হতে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) গঠন করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলায় ট্রাস্ট ফান্ড হতে এ পর্যন্ত ৩ হাজার কোটি টাকার প্রায় ৪৩১ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৬১টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। দেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব মোকাবেলায় গৃহীত নদীর তীর সংরক্ষণ, উপকূল অঞ্চলে বনায়ন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ, খাল খনন, পুনঃখনন, জ্বালানি সাশ্রয়ী বন্ধু চুলা স্থাপন, সোলার সিস্টেম স্থাপন, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন, সুপেয় পানি সরবরাহ, ড্রেনেজ নির্মাণসহ প্রভৃতি কাজ করে আসছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে জলবায়ুর অভিঘাত থেকে ধরিত্রী রক্ষায় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্যারিস চুক্তিতে অনুসমর্থন করার মধ্য দিয়ে ঐ চূক্তিতে স্বাক্ষরকারী অপর রাষ্ট্রসমূহ অনুসমর্থন করে তা দ্রুতই বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন। তবেই বাঁচবে বিশ্ববাসী, রক্ষা পাবে ধরিত্রী। সড়ঃধযবৎনফ@মসধরষ.পড়স
×