ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশংসিত বাতিঘরের ‘অলিখিত উপাখ্যান’

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রশংসিত বাতিঘরের ‘অলিখিত উপাখ্যান’

পান্থ আফজাল ॥ দর্শক সঙ্কট নিয়েও বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে মঞ্চ নাটকের জয়জয়কার। কারণ বাংলাদেশের মঞ্চনাটক এখন বিশ্ব মানের। এই প্রেরণায় অনেক সঙ্কটের আল ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের দেশের মঞ্চনাটকের আন্দোলনের গতি। মঞ্চে আসছে নতুন নতুন ব্যতিক্রমী সব প্রযোজনা। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মঞ্চে এসেছে বাতিঘরের দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘অলিখিত উপ্যাখান’। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়নেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর কারণ নাটকের গল্প উপন্যাসভিত্তিক হলেও তার অনেকটাই ঐতিহাসিক। নাটকে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষার উদ্ধৃতিতে উঠে এসেছে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীর একাধিক চরিত্র। উপন্যাসের মতো ‘অলিখিত উপাখ্যান’ নাটকে উঠে এসেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অজানা দৃশ্যপট। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি থেকে ইতিহাস চাপা পড়া যে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীর নাম পাওয়া যায়, তিনি রহিমউল্লাহ। নীল বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে খুলনা অঞ্চলের সরালিয়ায় ইংরেজ জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এই রহিমউল্লাহকে উপন্যাসিক রিজিয়া রহমান হারানো ইতিহাস থেকে তুলে এনেছেন তার ‘অলিখিত উপাখ্যান’ উপন্যাসে। এই উপাখ্যান সেই সময়ের ইংরেজ বেনিয়াদের শোষণের আখ্যান। কালো মানুষগুলোর মার খেতে খেতেও গর্জে ওঠার আখ্যান। জানা যায় কথাসাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরির পাতায় লেখা হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীর বীরত্বাগাথার কথা। সেখানে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে রিজিয়া রহমান লিখেছিলেন অলিখিত উপাখ্যান নামের উপন্যাস। আর উপন্যাসটিকে আশ্রয় করে ঢাকার মঞ্চে নাট্যদল বাতিঘরের দ্বিতীয় প্রযোজনায় যুক্ত হয়েছে অনিবার্যভাবে। গত নবেম্বর থেকে টানা মহড়ার পর ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চায়ন হয়েছে ‘অলিখিত উপাখ্যান’। জনপ্রিয় উপন্যাসিক রিজিয়া রহমানের উপন্যাস গবেষণার ভিত্তিতে নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন নির্দেশক মুক্তনীল। নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর প্রথম এই নাটকে কথকের ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছেন। নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী উপলক্ষে ঐদিন উপস্থিত ছিলেন দেশের বরেণ্য নাট্যজন মামুনুর রশীদ, আজাদ আবুল কালাম, রতন পাল, মানিক মানবিক প্রমুখ। মঞ্চায়নের পর নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেন উপস্থিত দর্শকরা। বিশেষ করে নাটকের গল্প নির্বাচন, উপস্থাপনার আঙ্গিক, তারুণ নির্ভর নির্দেশনার নতুনত্ব এবং শিল্পীদের নান্দনিক অভিনয়ে অনেকটাই মুগ্ধ হয় দর্শকশ্রোতারা। নাটকের গল্পে দেখা যায় চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মোরেল কুঠিতে কিছু সাদা চামড়ার মানুষের অমানবিক অত্যাচার দেখে আহত হয় তাদেরই একজন, মোরেল পরিবারের ছোট মেয়ে এ্যানা। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রƒক্ষেপ না করেই প্রজাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে যেতে থাকে ছোট জমিদার হেনরী মোরেল ও তার সহযোগী ম্যানেজার জেমস হেইলি। চাষীদের দিয়ে জোর করে অথবা মিথ্যা মামলা দিয়ে কয়েদি বানিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে সুন্দরবন কেটে আবাদ করানোর প্রতিবাদে ও গ্রামের লোকের একমাত্র বিনোদনের উৎস কালাচাঁদ ফকিরের মেলা বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে কৃষক বিপ্লবী রহিমউল্লাহ ও তার দল। রহিমউল্লাহর দলের সাহসী জোহরার দিকে নজর পড়ে জমিদার হেনরী মোরেলের। রূপসী জোহরাকে কাছে পাওয়ার জন্য মরিয়া হেনরী উত্তেজনার আতিশয্যে অস্থির হয়ে কালো চামড়ার মানুষগুলোকে কয়েদি বানিয়ে ছোটে সুন্দর বন কেটে আবাদ ও বসতি গড়তে। বনের হিংস্র জন্তু, সাপ-পোকামাকড়ের কামরে একের পর এক কয়েদি মারা পড়তে থাকে। এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হেনরী মেতে ওঠে আহত কয়েদিকে টোপ বানিয়ে ম্যানইটার বাঘ শিকারের পাষ- ক্রিয়ায়। অন্যদিকে ম্যানেজার হেইলি গ্রামের স্থানীয় কিছু মীর জাফরকে সঙ্গে নিয়ে রহিমউল্লাহকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বন্দী হতে হয় রহিমউল্লাহর কথিত বোন জোহরাকে। হেনরী ও বেইলির নৃশংসতা থেকে বাঁচতে পারে না জোহরা। কিন্তু নিজে মরে তার গোত্রের মানুষগুলোকে আন্দোলনের খোরাক দিয়ে যায় জোহরা। নাটক প্রসঙ্গে লেখিকা রিজিয়া রহমান বলেন, আমার ‘অলিখিত উপাখ্যান’ উপন্যাসটি নাট্যরূপ দেয়ার জন্য মুক্তনীলকে ধন্যবাদ। বাংলাদেশের নাট্য অঙ্গনে এটি সার্থক নির্ভুল ও শিল্পীত একটি প্রয়াস হিসেবে দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেই প্রত্যাশা করি। নাটকের নির্দেশক ও বাতিঘরের দলীয় প্রধান মুক্তনীল বলেন, আসলে আমি তো নির্দেশক বলতে যা বোঝায় তা নই। সেই অবস্থান থেকে কিছু বলা আমার জন্য ঔদ্ধতা প্রকাশ। তবে আমি বলতে পারি এটি শুধু আমার একজন কৃষক বিপ্লবীর অস্তিত্ব জানান দেয়ার চেষ্টা মাত্র। তবে আমার আনন্দ এই যে প্রথম প্রদর্শনীতেই আমি যথেষ্ট সাড়া পেয়েছি। বিশেষ করে নাটক মঞ্চায়ন শেষে সুধীজনরা এর প্রশংসা করেছেন উৎসাহ দিয়েছেন। আমি অন্য দর্শকদেরও বলব যে নাটকটির পরবর্তী প্রদর্শনী দেখে আপানারা যদি আপনাদের মূল্যবান মতামত ও ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো ধরিয়ে দেন তাহলে সেটিই হবে আমার প্রাপ্তি। নাটকে অভিনয় করেছেন পান্থ আফজাল, স্মরণ বিশ্বাস, তাবাচ্ছুম চেরী, মনিরুজ্জামান ফিরোজ, সাফিন আহম্মেদ অশ্রু, সাদ্দাম রহমান, সাবরিনা শারমিন, ফয়সাল, সাদিয়া ইউসুফ বৃতা, তাজিম আহমেদ শাওন, সঞ্জয় গোস্বামী, রুম্মান শারু, সঞ্জয় হালদার, শিশির, পরশ, শাম্মি মৌ, তানি, তন্ময় প্রমুখ। নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা, আলোক পরিকল্পনায় পলাশ হেনড্রী সেন, কস্টিউম ও প্রপস তাজিম আহমেদ শাওন ও শাম্মি মৌ, কোরিওগ্রাফি শিশির সরকার, সঙ্গীত সাদ্দাম রহমান। সঙ্গীত প্রক্ষেপণে অপূর্ব দে, পোস্টার ও প্রচ্ছদ করেছেন এম আসলাম লিটন।
×