ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাবনায় ‘শেকড় থেকে শিখরে’

বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য বাঙালীর সংগ্রামের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য বাঙালীর সংগ্রামের ইতিহাস

আলাউল হোসেন ॥ বাঙালী বীরের জাতি। আছে আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। এক সময় বাঙালীর মুখের ভাষাও কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্র হলো। এরপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর তার পরেই সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালী ইতিহাস। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালী জাতি পেল এক মহানায়ক। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রজ্ঞা, চিন্তা-চেতনা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালী জাতিকে তুলে আনলেন ‘শেকড় থেকে শিখরে’। একাত্তরে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভাস্কর্য। তেমনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা শিল্পকর্ম। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু ও বাংলার ইতিহাস ভিত্তি করে পাবনার বেড়ায় নির্মিত ‘শেকড় থেকে শিখরে’ ভাস্কর্যটি ব্যতিক্রম। ১০ ফুট উচ্চতার কংক্রিটের স্তম্ভের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ১৮ ফুট উচ্চতার বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য। তৈরি করা হয়েছে স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে। বাংলাদেশে স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি এটিই বঙ্গবন্ধুর সর্ববৃহৎ আবক্ষ ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যের দু’পাশে রয়েছে তিনটি করে স্তম্ভ। যাতে সিমেন্ট কেটে অঙ্কিত হয়েছে ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির উত্থান-পতন ও উন্নয়নের ধারা। ভাস্কর্যটির আরও একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মূল ভাস্কর্যের এক পাশে ২৬টি কলামের সীমানা প্রাচীর রয়েছে। যার প্রত্যেকটি কলামে টাইলসের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার ইতিহাস। যেখানে সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে সিরাজ-উদ-দৌলা থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭৫-এর জাতির জনকের পরিবারের ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সচিত্র ইতিহাস। এসব ছাড়াও সম্মুখ দেয়ালে ভাস্কর্যের উদ্যোক্তা খন্দকার আজিজুল হক আরজুর (এমপি, পাবনা-২) একটি ম্যুরাল পেইন্টিং স্থাপন করা হয়েছে। ‘শেকড় থেকে শিখরে’ ভাস্কর্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- ছাত্রছাত্রী তথা যে কেউ এটি একবার দেখলে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবে। বাঙালীর গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সমগ্র জাতির সঙ্গে পাবনার বেড়া অঞ্চলের হাজারও মানুষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অনেকেই শাহাদাতবরণ করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বেড়ার ডাববাগান যুদ্ধই একাত্তরের প্রথম সংঘটিত সম্মুখযুদ্ধ। এ কারণে পাবনা জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসংবলিত উল্লেখযোগ্য একটি স্থাপনা এলাকাবাসীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে নগরবাড়ী ঘাটের অদূরে নাটিয়াবাড়িতে ‘ধোবাখোলা করোনেশন স্কুল এ্যান্ড কলেজে’র প্রধান ফটকের পাশে পাবনা-২ আসনের (বেড়া-সুজানগর) সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু গত বছর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেন। নক্সা তৈরির দায়িত্ব দেন তরুণ শিল্পী বিপ্লব দত্তকে। প্রায় দেড় বছর নিরলস পরিশ্রমের পর নির্মাণ করেন বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এ ভাস্কর্য। স্থপতি বিপ্লব দত্ত বলেন, এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ করেন ভাষার জন্যও। অস্তিত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির জন্য সংগ্রাম করেন। নতুন প্রজন্ম এ সংগ্রাম দেখেনি। বই পড়ে, বড়দের কাছে গল্প শুনে স্বাধীনতার ইতিহাস কিছুটা জানে তারা। তাই বাংলার সঠিক ইতিহাস ও সংগ্রামের বিভিন্ন দিক বিশেষভাবে তুলে ধরাই এই ভাস্কর্যের মূল থিম। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনা তুলে ধরা এবং চোখের সামনে বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ ফুটিয়ে তোলার জন্যই এটি নির্মাণ। নিজের এলাকায় কাজটি করতে পেরেও আমি গর্বিত। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক মাস্টার বলেন, কোন জাতির গৌরবগাথা ধরে রাখে তার শিল্প, সাহিত্য ও ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকর্মও গৌরবোজ্জ্বল মুক্তি সংগ্রামের কথা বলে। ভাস্কর্যটি জাতীয় জীবনে নান্দনিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ধোবাখোলা করোনেশন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস তথা বাঙালী জাতির ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু যে ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন, তাতে নতুন প্রজন্ম উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এখান থেকে ইতিহাসের সঠিক পাঠ নিতে পারবে। ভাস্কর্যটি নির্মাণ সম্পর্কে উদ্যোক্তা সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু বলেন, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব সাম্প্রতিককালের ঘটনা হলেও এর পেছনে রয়েছে এক গৌরবময় দীর্ঘ ইতিহাস। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পরাধীন জাতির মুক্তির জন্য ফকির মজনু শাহ, তিতুমীর, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, দুদু মিয়া, ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য্যসেন, স্যার সৈয়দ আহমেদ, নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার চেতনায় বেগবান ছিলেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন এবং দেশ স্বাধীন করেন। কিন্তু ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশ স্বাধীনতাবিরোধী তথা বিশ্বাস ঘাতকদের দখলে চলে যায়। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্নসহ নিজস্ব অর্থায়নে ফ্লাইওভার, হাতিরঝিল, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেলের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা জয় করে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। মা-মাটি-মানুষ, ভাষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি সর্বোপরি আমাদের জীবনমুখিতাই আমাদের আপন পায়ে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে, শেকড় থেকে শিখরে ওঠার প্রেরণা দিয়েছে। বাংলার মানুষের জন্মকথা, প্রাচীন, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ, বাঙালীর শিক্ষা-সংস্কৃতি-শিল্পকলা-নানা ধর্মের বিকাশ ও বিস্তার, অসাম্প্রদায়িক জীবনচর্চা, উনিশ শতকের হিন্দু-মুসলিম সমাজ সংস্কার, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, ভাষার জন্য লড়াই, স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সব কিছুর ধারাবাহিক উপস্থিতি আছে এই শিল্পকর্মটিতে। তাই নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেবার জন্য এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে। বিশাল পরিসরে নির্মিত এ ভাস্কর্য একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি বাড়িয়ে দেয় ঐতিহ্যবাহী নগরবাড়ি ঘাটের গৌরব। প্রতিদিন স্থানীয় বাসিন্দা, পথচারী ও হাজারও যাত্রী মুক্তিযুদ্ধের এ ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে বিস্ময়মুগ্ধ হয়ে তাকান। শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও জাগরণের মধ্য দিয়ে মানুষজন এ ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে যেন দেখে বাংলাদেশকেই। যে দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। বহুদূর থেকে দৃশ্যমান এ ভাস্কর্যের আবেদনও তাই বহুমাত্রিক।
×