ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আপীল বিভাগের রায়ে ১৩৫ কার্যদিবসের বাধ্যবাধকতা শিথিল

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার দ্রুত শেষ হয় না

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার দ্রুত শেষ  হয় না

আরাফাত মুন্না ॥ ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ময়মনসিংহ শহরের কাছে ছেচু মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে গুলিতে নিহত হন হারুনুর রশিদ নামে কাঁচামালের এক আড়তদার। এ ঘটনায় পরদিন ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন হারুনুর রশিদের ভগ্নিপতি মোশারফ হোসেন বাবুল। পরে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। ২০১০ সালের ১০ জুলাই এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ৭৮ সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে কারাগারে থাকা আসামি আবদুর রশিদ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে জামিন আবেদন করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করায় আসামি রশিদের পক্ষে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। গত ২৫ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ হত্যা মামলার বিচার ২৬ বছরে কেন শেষ হয়নি, তার ব্যাখ্যা চায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের কাছে। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারককে এ বিষয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়। জানা গেছে, গত মাসে ট্রাইব্যুনাল থেকে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে জবাব দাখিল করা হয়েছে। ওই ট্রাইব্যুনালের বিচারক নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারেননি এবং মামলার নথি আগের আদালতে ফেরতও পাঠাননি। নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ ও নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনে ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করার বিধান রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কোন মামলার বিচার শেষ করা সম্ভব না হলে যে আদালত থেকে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছিল, সে আদালতে নথি ফেরত পাঠানোর বিধান আছে। তবে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের এক রায়ে ১৩৫ কার্যদিবসের বাধ্যবাধকতা বাতিল করে বলা হয়, মামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে সময় বাড়ানো যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ রায়ের ফলে দ্রুত বিচার আর দ্রুত শেষ হচ্ছে না। আইনজীবীরা বলছেন, আপীল বিভাগের এ নির্দেশনা সব মামলার ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে না। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি হচ্ছে না, সেসব ক্ষেত্রে আপীল বিভাগের নির্দেশনা দেখিয়ে বিচার কার্যক্রমে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এছাড়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ সুপ্রীমকোর্টকে জানানোর বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। এতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাদী বা সাক্ষীকে পুলিশ খুঁজে না পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকে মামলার বিচার কার্যক্রম। মনিটরিং সেলের কার্যক্রম না থাকায় এমন মামলার সংখ্যা জানাতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা মামলার বিচারও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে। এক যুগ পার হলেও এখনও এ মামলার বিচার শেষ হয়নি। জানতে চাইলে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ট্রাইব্যুনালে ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির যে বিধান ছিল তা ২০০৮ সালে আপীল বিভাগের দেয়া রুলিংয়ে শিথিল হয়ে গেছে। এখন আর বাধ্যবাধকতা নেই। মামলার গুরুত্ব বিবেচনায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি ট্রাইব্যুনালে চলতে আইনগত বাধা নেই। কম সময়ের মধ্যে আলোচিত মামলাটি নিষ্পত্তি করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। দেশের বিভিন্ন আদালতে বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে লাখ লাখ মামলা। সাধারণত দুই থেকে তিন মাস পরপর মামলার তারিখ পড়ে। তবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রতি সপ্তাহে মামলার তারিখ পড়ে। ফলে দ্রুত বিচারের আশায় বুক বাঁধেন বিচারপ্রার্থীরা। তবে দ্রুত বিচারের জন্য আসা মামলার নথি অনেক ক্ষেত্রে আগের আদালতে ফেরত যাওয়ায় নিষ্পত্তি নিয়ে সংশয়ে থাকেন বিচারপ্রার্থীরা। আইন কর্মকর্তারা জানান, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো যেসব মামলা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় না, সেসব মামলার নথি আগের আদালতে ফেরত পাঠানো হয়ে থাকে। এছাড়া অন্য বিচারাধীন পুরনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হচ্ছে। এ রকম মামলা আছে শত শত। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ৩ জুলাই সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ এসএম মোজাম্মেল হক তালুকদার ওরফে শাহজাহান তালুকদার বনাম রাষ্ট্র মামলার রায়ে ১৩৫ কার্যদিবসের বাধ্যবাধকতা বাতিল করে। ওই রায়ে বলা হয়, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনে ১৩৫ কার্যদিবসের যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে তা বাধ্যবাধকতা নয়, নির্দেশনামূলক। তাই সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল ১৩৫ কার্যদিবস শেষ হওয়ার পরও প্রয়োজনে বিচার চালিয়ে গেলে তা বেআইনী হবে না। সারাদেশে ৯টি ট্রাইব্যুনাল ॥ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে চাঞ্চল্যকর মামলা বাছাইয়ের পর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। বর্তমানে ঢাকায় চারটি ও পাঁচটি বিভাগীয় শহরে পাঁচটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর এসব ট্রাইব্যুনালে আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর অনেক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়েছে। বর্তমানে ঢাকার চারটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে রয়েছে মাত্র ৪২টি বিচারাধীন মামলা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে রয়েছে মাত্র তিনটি মামলা। অপর চারটি বিভাগীয় ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যাও অনেক কম। যে কারণে গঠন হয়েছিল দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ॥ অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধের মামলা নিষ্পত্তি করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। দুর্ধর্ষ ও দাগী অপরাধীরা আইনের ফাঁক-ফোকর ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে জামিনে বের হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে এসব অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন গুরুতর অপরাধসংক্রান্ত মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা, সন্ত্রাস দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ করে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, বিস্ফোরক, অবৈধ অস্ত্র ও মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত অপরাধের বিচার দ্রুত শেষ করতে ২০০২ সালে সরকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন করে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী কতিপয় অপরাধের দ্রুত বিচারের উদ্দেশ্যে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করে একই বছরে আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন পাস করা হয়। এ বিষয়ে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি আবু আবদুল্লাহ ভূঁঁইয়া বলেন, ১৩৫ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে- আপীল বিভাগের রায়ের পর এমন বাধ্যবাধকতা আর নেই। আপীল বিভাগের রায়ের ফলে মামলা পরিচালনায় কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপীল বিভাগ আইনটি আরও সহজ করে দিয়েছে। ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি মাহবুবুর রহমান জানান, আপীল বিভাগের এ রায়ের ফলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে কোন মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিচারকাজ চালিয়ে যাওয়া যাবে।
×