ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুতই ট্রেন চলবে, বহুল প্রতীক্ষিত রেল যোগাযোগে নতুন অধ্যায়

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ আর পাবনা-ঢালারচর রেললাইন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ আর পাবনা-ঢালারচর রেললাইন হচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ রেল যোগাযোগ বাড়াতে উত্তরাঞ্চলে নতুন রেলপথ বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। এক শ’ বছরের বেশি সময় পর পাবনা জেলা শহরের মানুষ রেল স্টেশন পাচ্ছে। এতকাল তাদের রেলে ঈশ্বরদীতে নেমে সড়কপথে পাবনা যেতে হতো। এদিকে বহু প্রতীক্ষিত বগুড়া থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্তে রেল যোগাযোগের প্রকল্পের সারপত্র ও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে ট্রেনে ঢাকা পৌঁছতে সময় অনেক কম লাগবে। এতকাল অনেকটা ঘুরপথে ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকা যেতে হতো। সূত্র জানায় ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার রেল লাইন ও স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্তে ৭০ কিলোমিটার নির্মাণের প্রকল্প সারপত্র পরিকল্পনা কমিশনে গেছে। উত্তরাঞ্চলের পাবনা ও নওগাঁ জেলার কোন রেল স্টেশন নেই। সান্তাহার রেল জংশন থেকে নওগাঁ পর্যন্ত সড়ক পথে অতি স্বল্প স্বল্প দূরত্বে লোকজন যাতায়ত করে। আর পাবনার সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ না থাকায় লোকজনকে রেলে ভ্রমণ করতে অনেকটা ঘুরপথে যেতে হয়। পাবনার মানুষের জন্য রেল পথে ভ্রমণ কখনই সাশ্রয়ী নয় এবং সময় বেশি লাগে। এই অবস্থার উত্তরণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পাবনার ওপর দিয়ে রেল পথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ঈশ্বরদীর মাজগ্রাম রেল স্টেশন থেকে পাবনা শহর হয়ে বেড়ার ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার রেল লাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এই পথে আগে রেল লাইন ছিল না। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৪ সালে পদ্মা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর সময় বলা হয়েছিল, একটি লিংক রেল লাইন ঈশ্বরদী হয়ে পাবনা পর্যন্ত যাবে। এক শ’ বছরেও তা নির্মিত হয়নি। বর্তমান সরকার দেশে রেল যোগাযোগের সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তারই আলোকে প্রথম পর্যায়ের দুই ভাগে ঈশ্বরদীর মাজগ্রাম থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেল লাইন ও রেল স্টেশন নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯শ’ ৮৩ কোটি টাকা। এর আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। কথা আছে দুই বছরের মধ্যে এই রেল পথে ট্রেন চলবে। এই বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ সুবোক্তগিন জানান, আগামী বছরের মধ্যে ঈশ্বরদীর মাজগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইনে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। পরবর্ত্তী বছরের প্রথমার্ধেই পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত ট্রেন চলবে। এই রেলপথটি ডুয়েল গেজ হবে না। শুধু ঈশ্বরদীর মাজগ্রাম রেল স্টেশনের মান উন্নীত করে এই পর্যন্ত ডুয়েল গেজ থাকবে। ৭৮ কিলোমটার দীর্ঘ এই রেলপথে নতুন রেল স্টেশন নির্মিত হবে এগারোটি। স্টেশনগুলো বি ও ডি ক্যাটাগরির। রেল পথে ছোট বড় মিলিয়ে সেতু থাকছে ১১৩। লেভেল ক্রসিং থাকছে অন্তত ৫০। এই রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৪ দশমিক ২১ একর। রেল সূত্র জানায়, মাজগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত রেল লাইন ও রেল স্টেশন স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পাবনা পর্যন্ত রেল পথ ও রেল স্টেশন নির্মিত হওয়ার পর প্রকল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাবনা থেকে সুজানগর ও সাঁথিয়া উপজেলার আংশিক হয়ে বেড়া উপজেলার ঢালারচর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হবে। এই এলাকায় রেল সংযোগ শুরু হওয়ার পর মাঠ পর্যায়ের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। উল্লেখ করা যায় বৃহত্তর পাবনা দেশের সবচেয়ে বড় তাঁত প্রধান এলাকা। এই অঞ্চলের তাঁতের শাড়ি দেশের সুনাম ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে বড় আসন করে নিয়েছে। পাশাপশি কৃষিপন্য উৎপাদনে বড় ভূমিকা রেখেছে এই অঞ্চল। পণ্য পরিবহন ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রী ভ্রমণে রেল পথ সুদূরপ্রসারী ভাবনা নিয়েই নির্মিত হচ্ছে। রেল লাইন নির্মাণে রেল স্টেশন কেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রবাহ বেড়ে যাবে। এদিকে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা অনেক আগের। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় উত্তরাঞ্চলের বড় একটি এলাকার সঙ্গে অল্প সময়ে রাজধানীর যোগাযোগের প্রস্তাব দেয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। সে সময়ে ঠুনকো পরিবেশের অজুহাত দেখিয়ে রেল লাইন প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে রেলপথটি নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরে আন্দোলন শুরু হয়। সরকার প্রধানের কাছে এই রেলপথ নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরা হলে ২০১৫ সালের ১২ নবেস্বর বগুড়ায় আলতাফুন্নছা খেলার মাঠের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেল লাইন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। তারই আলোকে প্রকল্প তৈরি করে দ্রুত নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, গত এপ্রিলে রেল মন্ত্রণালয় থেকে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কাছে এক বার্তা প্রেরণ করা হয়। এই বার্তায় বলা হয়- বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্তের শহীদ এম মনসুর আলী রেল স্টেশন পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণের সকল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প সারপত্র (পিসিপি) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পেপার ওয়ার্ক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ওই বার্তায় জানানো হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জিটুজি (গবর্নমেন্ট টু গবর্নমেন্ট) ভিত্তিতে চীনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানির সঙ্গে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। আশা করা হয়েছে শীঘ্রই প্রকল্পটি পরবর্তী ধাপে অনুমোদিত হবে। এই রেলপথটি নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের লোকজনকে ইশ্বরদী হয়ে ১৩০ কিমি ঘুরপথে ঢাকা পৌঁছতে হবে না। উত্তরাঞ্চলের মানুষকে বর্তমানে রেলপথে ঢাকা পৌঁছতে ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগে। আর সড়ক পথে ঢাকা পৌঁছতে সময় নেয় দূরত্ব ভেদে সাড়ে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা। বগুড়া রেল স্টেশনের ওপর দিয়ে উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি আন্তনগর ট্রেন চলছে ঘুরপথে। বগুড়া সিরাজগঞ্জ রেলপথ চালু হলে অনেক কম সময়ে উত্তরাঞ্চলের মানুষ ঢাকা পৌঁছবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ সারাবিশ্বে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণে রেল যোগাযোগকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। দেশে এতদিন রেলপথকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়। বর্তমান সরকার পূর্বাঞ্চলে ও উত্তরাঞ্চলে রেল যোগাযোগ বাড়াতে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে।
×