ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঐশি দুর্ঘটনায় ২৫ লাশ উদ্ধার

অবহেলার অভিযোগে মালিক চালকের বিরুদ্ধে মামলা ॥ এখনও নিখোঁজ ১০

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অবহেলার অভিযোগে মালিক চালকের বিরুদ্ধে মামলা ॥ এখনও নিখোঁজ ১০

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে যাত্রীবাহী ‘এমএল ঐশি-২’ লঞ্চডুবির ঘটনায় শুক্রবার সকালে আরও তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যরা। এদের মধ্যে দুই নারী ও একটি শিশু। মৃতদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ নিয়ে ‘ঐশি ট্র্যাজেডি’তে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ জনে। লাশের মিছিলে একের পর এক মরদেহ যুক্ত হওয়ায় শুক্রবার দিনভরও সন্ধ্যা নদীর পাড়ে নিহত ও নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। নিখোঁজ যাত্রীদের মরদেহের অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনও ১০ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন। এদিকে শুক্রবার দুপুরে ঐশির মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অবহেলার অভিযোগে বানারীপাড়া থানার এসআই মোঃ জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে ‘এমএল ঐশি-২’ লঞ্চডুবির ঘটনায় মালিক ইউসুফ হাওলাদার ও চালক নয়নকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ওসি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিরা অধিক লাভের আশায় অবৈধভাবে যাত্রী বহন করেন। তাদের অবহেলার কারণে লঞ্চ ডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিমজ্জিত লঞ্চ উদ্ধারের পর সকাল দশটায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে জেলা প্রশাসন। এরপর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনরা নিজ উদ্যোগে ট্রলার ভাড়া করে তল্লাশিতে নামেন। ফলশ্রুতিতে বৃহস্পতিবার রাতে সন্ধ্যা নদী ও বিভিন্ন খাল থেকে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধার করা লঞ্চের মধ্য থেকে চার শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনার পর বুধবার দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩ জনের মরদেহসহ শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ২৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১০ নারী, সাত শিশু ও আটজন পুরুষ। পুলিশের তালিকায় দুজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানানো হলেও শুক্রবার সকালে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনায় জেলা প্রশাসকের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাকির হোসেন জানান, শুক্রবার সকাল দশটা পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বানারীপাড়া থানার ওসি জিয়াউল আহসান জানান, শুক্রবার সকালে সৈয়দকাঠী গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৪৫), কেশবকাঠীর দিদার (৮) ও উজিরপুরের হিজলকাঠী গ্রামের আল্পনার (২৫) মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কোস্টগার্ড বরিশাল দক্ষিণ জোনের উদ্ধারকারী ডুবুরি দলের নেতৃত্বদানকারী জোনাল কমান্ডার এসএম সেলিম জাহাঙ্গীর (লে. কমান্ডার বিএন) জানান, বৃহস্পতিবার রাতে বানারীপাড়া ফেরিঘাট এলাকায় ভেসে ওঠার পর সাতবাড়িয়া গ্রামের আলমগীর হোসেনের একমাত্র কন্যা মারিয়া (৩), সন্ধ্যা নদী সংলগ্ন নলশ্রী খালের বাংলাবাজার পয়েন্ট থেকে উজিরপুরের পূর্ব কেশবপুরের খলিল হাওলাদারের স্ত্রী হামিদা বেগম (৪০), খেজুরবাড়ি এলাকা থেকে পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) ফায়ার স্টেশনের সদস্য রুহুল আমিন (৩০) ও পূর্ব সৈয়দকাঠী গ্রামের মিলন ঘরামীর স্ত্রী খুকু মনি (২৫) এবং চাউলাকাঠির কালিবাজার সংলগ্ন নদী থেকে অজ্ঞাত (৬০) এক বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর পূর্বে বৃহস্পতিবার সকালে নিহত খুকু মনির স্বামী প্রবাসী মিলন ঘরামী ও শিশু সন্তান সাফওয়ানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শুক্রবার ভোরে উদ্ধার হওয়া পাঁচ মরদেহের মধ্যে চারজনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বরিশাল নদীবন্দর কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঐশির মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটি’র পক্ষ থেকে মেরিন আইনে মামলাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। শুক্রবার সন্ধ্যা নদীর তীরে নিখোঁজ যাত্রীদের মরদেহের অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনও ১০ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন। পুলিশ কন্টোল রুমের দেয়া তথ্যমতে, ঐশি ট্র্যাজেডিতে নিহত সাত শিশু হলো বানারীপাড়ার জিরাকাঠী গ্রামের মিলন ঘরামীর পুত্র সাফওয়ান (৩), রহিম হাওলাদারের পুত্র রিয়াদ (৫), সাতবাড়িয়ার আলম মীরের কন্যা মাফিয়া (৩), উজিরপুরের মশাং গ্রামের সিদ্দিকুর রহমানের কন্যা শান্তা (১০) ও পুত্র রাব্বি (৫), নেছারাবাদের উত্তর কারফা গ্রামের কামাল হোসেনের মেয়ে মাইশা (১৪ মাস), পূর্ব কেশবকাঠীর খলিলুর রহমান হাওলাদারের পুত্র দিদান (৭)। নিহত ১০ নারী হচ্ছেন পূর্ব সৈয়দকাঠী গ্রামের মৃত চান্দু সন্যামতের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৪৫), বানারীপাড়ার রহিম হাওলাদারের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৩৫), নেছারাবাদের উত্তর কারফা গ্রামের কামাল হোসেনের স্ত্রী হিরা বেগম (২৫), সাতবাড়িয়ার আব্দুল মজিদ হাওলাদারের স্ত্রী ফিরোজা বেগম (৫৫), উত্তর সাতবাড়িয়ার মজিবুর রহমান বেপারীর স্ত্রী কোহিনুর বেগম (৬০), পূর্ব কেশবকাঠীর খলিল হাওলাদারের স্ত্রী হামিদা বেগম (৪০), জিরাকাঠীর মিলন ঘরামীর স্ত্রী খুকু মনি (২৫), মসজিদবাড়ির আব্দুল মজিদ হাওলাদারের স্ত্রী রহিমা বেগম (৬০), ইদেলকাঠীর মণি শংকরের স্ত্রী আল্পনা (২৪) ও পশ্চিম জিরাকাঠীর সায়েদ আলী ঢালীর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৪৫)। নিহত ৮ পুরুষ হলেন জিরাকাঠীর আবুল হোসেন ঘরামীর পুত্র প্রবাসী মিলন ঘরামী (৩২), মসজিদবাড়ির মৃত ইসমাইল মোল্লার পুত্র মোজাম্মেল মোল্লা (৬২), সাতলা নয়াকান্দির সিরাজুল হাওলাদারের পুত্র জয়নাল হাওলাদার (৫৭), হারতার মনিন্দ্রনাথ মল্লিকের পুত্র সুখদেব মল্লিক (৩৫), কেশবকাঠীর মৃত অহেদ হাওলাদারের পুত্র আব্দুর রাজ্জাক (৬৮), সাতবাড়িয়ার আলম মীরার পুত্র সাগর (১৮), আলেক সরদারের পুত্র রুহুল আমিন (৩০) ও আব্দুর রহমান হাওলাদারের পুত্র আব্দুল মজিদ হাওলাদার (৬৫)। উল্লেখ্য, গত বুধবার বেলা ১২টার দিকে অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে সন্ধ্যা নদীর বানারীপাড়া থেকে উজিরপুরের হাবিবপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা একতলা ‘এমএল ঐশি-২’ লঞ্চটি মসজিদবাড়ি দাসেরহাটের ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় ঘাট দেয়। এ সময় সিঁড়ি দিয়ে যাত্রী উঠানোর পূর্বে নদীপাড়ের বিশাল একটি মাটির অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়। এতে সেখানে ঘূর্ণিয়মান স্রোতের সৃষ্টি হলে লঞ্চটি কাত হয়ে ডুবে যায়। দুর্ঘটনার সময় বৃষ্টি থাকার কারণে লঞ্চের সকল জানালা বন্ধ ছিল। ফলে অধিকাংশ যাত্রী ভেতরে আটকা পড়ে। এর মধ্যে ১৪-১৫ যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও এদের মধ্যে একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনার প্রায় সাড়ে ২০ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক সন্ধ্যা নদীর ৬০ ফুট নিচে তলিয়ে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করে। নির্ভীকের ডুবুরি মোঃ ইমাম হোসেন জানান, নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় দুর্ঘটনাকবলিত স্থান থেকে প্রায় ১০০ ফিট দূরত্ব থেকে ঐশি-২ লঞ্চটি উদ্ধার করা হয়।
×