ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী, কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ও চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকা-ের তদন্তে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। যদিও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত হচ্ছে। দেরিতে হলেও মামলাগুলোর তদন্ত আলোর মুখ দেখতে পারে। একদিন হয়ত তদন্তে সত্য বেরিয়ে আসবে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও মামলাগুলো বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে বার বার তাগাদা দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সাগর-রুনী হত্যাকা-ের ডিএনএ টেস্টের সব রিপোর্ট র‌্যাবের হাতে এসেছে। রিপোর্ট পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক তদন্ত এগোচ্ছে। আগামী ৯ অক্টোবর আদালতে সাগর-রুনী হত্যার তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে। তনু হত্যায় সন্দেহভাজন তিনজনের ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর মিতু হত্যাকা-ের তদন্তে বিশেষ অগ্রগতি হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই হত্যার পুরো রহস্য উদ্ঘাটিত হবে বলে আশা করছেন তদন্তকারীরা। যদিও নিহতদের পরিবারের তরফ থেকে মামলার তদন্ত সঠিকপথে এগুচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সাগর-রুনি হত্যাকা- ॥ ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতের কোন এক সময় রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানাধীন পশ্চিম রাজাবাজারের শাহজালাল প্রপার্টিজ নির্মিত রশিদ লজের ৫৮/এ/২ নম্বর ৬ তলা বাড়ির চতুর্থ তলার এ-৪ নম্বর ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বেসরকারী মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সরোয়ার হোসেন সাগর ও তাঁর স্ত্রী বেসরকারী টেলিভিশন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে। ওই সময় বাসায় সাগর-রুনির একমাত্র ছেলে মেঘ ছিল। পরবর্তীতে তার মাধ্যমেই সাগর-রুনি হত্যাকা-ের বিষয়টি পরিবার জানতে পারে। এ ব্যাপারে শেরেবাংলানগর থানায় রুনির ভাই রুমান বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ১৯ মে হাইকোর্টের নির্দেশে বর্তমানে মামলাটি র‌্যাব তদন্ত করছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২৬ মে ভিসেরা আলামতের জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। লাশ থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়। চাঞ্চল্যকর মামলাটির উন্নত তদন্তের জন্য ওই বছরের ১২ জুন প্রথম দফায় ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত হিসেবে জব্দ করা একটি ছুরি, ছুরির বাঁট, সাগরের জুতোর মোজাসহ পরনের প্যান্ট এবং রুনির পরনের প্যান্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফোকল্যান্ড ফরেনসিক ও ডিএনএ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ওই বছরের ১৭ জুলাই হত্যাকা-ের সময় যে কাপড় দিয়ে সাগরের হাত ও পা বাঁধা ছিল, সেই কাপড় এবং রুনির টি-শার্ট পাঠানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই একই পরীক্ষাগারে। প্রথম দিকে হত্যাকা-ের অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে বাড়িটির নিরাপত্তারক্ষী হুমায়ুন কবির ওরফে এনামুল হককে (২৩) শনাক্ত করা হয়। তাকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এনামুল র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারও হয়। এনামুল তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। ছোটবেলা থেকেই এনামুল চুরির সঙ্গে জড়িত। বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানাধীন দক্ষিণভাগ গ্রামে। ২০০৭ সালে কুখ্যাত চোর হিসেবে এনামুলের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। তাকে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে তাবলীগ জামাতে পাঠানো হয়। তারপরও এনামুলের স্বভাব বদলায়নি। ২০১০ সাল থেকে এনামুল নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি করছিল। সাগর-রুনি খুনের মাত্র এগারো দিন আগে সে ওই বাসায় নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে চাকরি নিয়েছিল। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে পাঠানো সব আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট তাদের কাছে এসেছে। সে সব রিপোর্টের পর্যালোচনা চলছে। পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্য মোতাবেক মামলার তদন্ত এগুচ্ছে। আগামী ৯ অক্টোবর মামলার তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন উচ্চ আদালতে দাখিলের কথা রয়েছে। যদিও তদন্ত নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন মামলার বাদী নওশের আলম রুমান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবারই আশার কথা শুনি। কিন্তু সে আশার কথা বাস্তবে কবে রূপ নিবে তা অজানা। সোহাগী জাহান তনু হত্যাকা- ॥ চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনু হত্যাকা-ের শিকার হন। ওই রাতেই কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতরের ঝোপ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়। লাশের ময়নাতদন্ত হয় পরদিন। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা মির্জানগর গ্রামে দাফন করা হয়। ময়নাতদন্ত নিয়ে বির্তক শুরু হলে আদালদের নির্দেশে ২৮ মার্চ লাশ তুলে দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত হয়। পরবর্তী সময়ে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি। ওই সময় লাশ থেকে ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গত ১ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার সিআইডিতে স্থানান্তরিত হয়। গত মে মাসে ডিএনএ প্রতিবেদন হাতে পায় সিআইডি। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহমেদ। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, তনুর পোশাক থেকে ধর্ষণের আলামতসহ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত আলামতে তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই তিন ব্যক্তি কে তা এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তদন্তের স্বার্থে তনুর মা-বাবাসহ পরিবারের অনেকের সঙ্গেই একাধিকবার কথা বলা হয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তনুর মা সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তির সঙ্গে আলামত হিসেবে পাওয়া ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন। যে তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা লাশ থেকে পাওয়া গেছে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। আর তনুর মা যে তিন ব্যক্তির ডিএনএর সঙ্গে লাশের সঙ্গে পাওয়া ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখার দাবি করেছেন, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ না নিয়ে তনুর মায়ের সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখা আইনসিদ্ধ হবে কিনা সে বিষয়েও পর্যালোচনা চলছে। তনুর মায়ের বক্তব্য মোতাবেক সন্দেহভাজন ওই তিন ব্যক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরেই ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আদালত অনুমতি দিলে ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হবে। মামলাটির তদারক কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলার দায়িত্বে থাকা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ব্যারিস্টার মোশারফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মামলার তদন্ত সঠিকভাবেই এগুচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলাটির তদন্ত চলছে অত্যন্ত সর্তকর্তার সঙ্গে। আশা করছি স্বল্প সময়ের মধ্যেই মামলাটির তদন্তে আরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। হত্যা মামলাটির তদন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই আলোর মুখ দেখবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। যদিও তনুর পিতা মামলার বাদী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, তদন্তের কোন কিছুই ঠিক পাচ্ছি না। এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যা ॥ গত ৫ জুন সকালে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে একমাত্র ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হন। একটি মোটরসাইকেলে তিন যুবক মিতুকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ঘটনার সময় এক হত্যাকারী মিতুর ছেলেকে একপাশে সরিয়ে রাখে। ঘটনার সময় এসপি পদে পদোন্নতি পাওয়া বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করতে এসেছিলেন। স্ত্রী হত্যার পর থেকেই তিনি রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন মেরাদিয়ার ভুঁইয়াপাড়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর অঞ্চলের ২২০/এ নম্বর দোতলা বাড়িটিতে অবস্থান করছেন। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ১৮ কেজি স্বর্ণের চালান ধরা, জঙ্গীদের সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার এবং পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গী নিহত হওয়ার জেরধরে জঙ্গী অথবা কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী প্রতিশোধ হিসেবে বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে বলে ব্যাপক প্রচার পায়। ওই সময় ব্যাপক অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার হয় ছাত্রশিবিরের সাবেক কর্মী আবু নসুর গুন্নুু (৪৬), ইব্রাহিম, শাহ জামান ওরফে রবিন (২৮), নসুর, রবিন, জেএমবি সদস্য বুলবুল আহমেদ ওরফে ফুয়াদসহ অনেকেই। পরবর্র্তীতে দুইজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারাও যায়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেন নামে দু‘জন হত্যাকা-ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে গত ২৬ জুন আদালতে জবানবন্দী দেয়। পুলিশ সূত্র জানায়, জবানবন্দীতে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসার নাম আসে। মুসা রাঙ্গুনিয়ার ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ হত্যাসহ ছয় মামলার আসামি। সে বাবুল আক্তারের সোর্স। মিতু হত্যাকা-ের অস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে গ্রেফতারকৃত এহতেশামুল হক ভোলাও পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের সোর্স হিসেবে পরিচিত। এদিকে বাবুল আক্তারকে গভীররাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে টানা প্রায় চৌদ্দঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করায় মিতু হত্যাকা-ের মোড় ঘুরে যায়। স্ত্রী হত্যাকা-ের সঙ্গে বাবুল আক্তার জড়িত বলে বিভিন্ন সময় প্রকাশ পায়। যদি বাবুল আক্তার ও তার স্ত্রীর পরিবার এমন তথ্য ভিত্তিহীন বলে দাবি করে আসছে। সম্প্রতি বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ নিয়েও নানা গুঞ্জন আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জোরপূর্বক বাবুল আক্তারের কাছ থেকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়েছে। পদত্যাগ প্রত্যাহারের জন্য বাবুল আক্তার আবেদন করেছিলেন। যদিও পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি চাকরি করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকা-ের অগ্রগতি সম্পর্কে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ইকবাল বাহার জনকণ্ঠকে বলেন, আশা করছি স্বল্প সময়ের মধ্যেই মিতু হত্যাকা-ের তদন্তে অগ্রগতি হবে। পলাতক মূসাকে গ্রেফতার করতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। মূসাকে গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। তদন্তের স্বার্থে তিনি মামলাটির প্রকৃত অগ্রগতি সম্পর্কিত তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
×