ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আফরোজা নাসরিন

এবং মানুষ ॥ শারদীয় সম্ভাষণে উদ্ভাসিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এবং মানুষ ॥ শারদীয় সম্ভাষণে উদ্ভাসিত

ঋতু পরিক্রমায় বছর ঘুরে ঘুরে ষড়ঋতু আমাদের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে ফিরে ফিরে আসে। আর কবি-সাহিত্যিকরা এই ঋতুকে ঋতুর রানী হিসেবে রূপায়িত করেছেন তাদের লেখায়। এমনি শরৎ ঋতু নিয়ে সাহিত্য বিষয়ক ছোট কাগজ ‘এবং মানুষ’ শরতের প্রারম্ভেই ভাদ্র মাসে পাঠকের হাতে মেলে ধরেছেন ‘শরৎ’ সংখ্যাটি। বিষয় বৈচিত্র্য এবং লেখকসূচী দেখলেই অনুধাবন করা যায় ভেতরের নির্যাস, আর কি পরিমাণ রসদ মজুদ রয়েছে। মুক্তচিন্তা দিয়ে শুরু করা হয়েছে সংখ্যাটির প্রবন্ধ পাঠ। মুক্তচিন্তা বিভাগে ‘মুক্তবুদ্ধির জয়’ শিরোনামে লিখেছেন, যতীন সরকার। একটি বিশ্লেষণধর্মী ও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, পাঠকমাত্রই লেখাটি পাঠে আনন্দ পাবেন। মুক্তচিন্তা প্রচীন ভারতের লোকায়ত দর্শনের ধারায় যে বাংলার প্রাকৃতজনের ভেতরে আজ প্রবাহিত হয়ে আসছে তারই নির্মল যৌক্তিক বর্ণনা অনুরণিত হয়েছে এ প্রবন্ধে “লালন কথিত ‘মানুষের সৃজন’ এই আল্লাহ কিংবা হরিকে নিয়েও শ্রেণী বিভক্ত সমাজের কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠী নানা ভেদ-বিভেদের সৃষ্টি করেছে। সেই ভেদ-বিভেদেরই প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন প্রথাগত ধর্মে। সেই সব ধর্মকে অবলম্বন করে পরে সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষের। বিভিন্ন সম্প্রদায় আপন আপন ধর্মকেই ‘সত্য’ এবং অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মকে ‘মিথ্যা’ বলে প্রচার করেছে, ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে বাদ-বিবাদে প্রবৃত্ত হয়েছে। লোকসাধারণ কিন্তু একান্ত সহজ ও সাধারণ মুক্তবুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে ধর্মের সব রকম সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার ফাঁক ও ফাঁকিগুলো ধরে ফেলতে পেরেছে। লোকায়ত বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ সবেরই প্রকাশ আমরা দেখতে পাই।” এভাবেই প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও প্রাজ্ঞজন যতীন সরকার তার প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছেন। সময়োপযোগী এ লেখাটি ‘এবং মানুষ’ শরৎ সংখ্যাকে ঋদ্ধ করেছে। আর পাঠক পাচ্ছে একটি অনন্য অসাধারণ লেখা পাঠ করার সুযোগ। প্রবন্ধ বিভাগে আরও লিখেছেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মোজাম্মেল হক নিয়োগী, শাফিক আফতাব, শিবলী মোকতাদির, উদয় শঙ্কর দুর্জয় ও হাসনাত মোবারক। প্রত্যেকের প্রবন্ধেই শরতের ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিস্ফুটিত হয়েছে নানা মাত্রায়। যা থেকে শরতের নির্মল আকাশের মতো কিছু লেখা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘শরৎ কিন্তু ভাল নেই’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘গ্রীষ্মকালের স্বভাবটি পুঁজিবাদের মতো। উভয়েই ভীষণভাবে পুরুষতান্ত্রিক। পিতৃতান্ত্রিক বলাটাও অসঙ্গত নয়। গ্রীষ্মের মতোই পুঁজিবাদ দাম্ভিক ও উত্তপ্ত। দুইয়ে মিলে ধরণীকে তপ্ত করে তুলেছে। পুঁজিবাদ জ্বালানি পোড়ায়, বরফ গলায়, সমুদ্রকে স্ফীত করে। উত্ত্যক্ত করে প্রকৃতিকে। সমুদ্র তাই ফুঁসে উঠছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস পরিণত হয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায়। জলবায়ু বিপর্যয় সারা পৃথিবীকেই আঘাত করছে। গরিব মানুষ ও গরিব দেশেরই ভোগান্তি বেশি, তারা গরিব বলেই। শরৎ অবশ্য টিকে থাকবে। থাকবে সে শারদীয় দুর্গোৎসবে, রইবে টিকে স্মৃতিতে, সংস্কৃতিতে, কল্পনায়। কতটা বেঁচে থাকবে সে নিয়ে ভারি সন্দেহ। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা চাই। তার স্বার্থে নয়, আমাদের স্বার্থে। সে জন্য দরকার পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। গ্রীষ্মের এবং পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য পরস্পরের সহযোগী ও পরিপূরক। দাঁড়ানো দরকার পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, গ্রীষ্মকে যে তপ্ত, ভয়ঙ্কর ও সম্প্রসারিত করে তুলছে। দাঁড়ানো চাই শরতের পক্ষে।” এভাবেই তিনি শরৎ যে ভাল নেই তার সরল ব্যাখ্যা করেছেন। এ ধরনের একটি লেখার জন্য তাঁকে অনেক ধন্যবাদ দিতেই হয়। শরৎ যে ঋতুর রানী তা নিয়ে মোজাম্মেল হক নিয়োগী লিখেছেন, ‘ঋতুর রানী শরৎকাল’। শরতের রূপরস নিয়ে শুভ্রতার প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করে লেখা তার প্রাণবন্ত প্রবন্ধটি পাঠককে আনন্দ দেবে। এ ছাড়াও শাফিক আফতাব ‘বাংলা কবিতায় শরৎ বন্দনা’ শিরোনামে অনবদ্য একটি প্রবন্ধ লিখেছেন যা পাঠককে শরতের মতোই নির্মল আনন্দ দেবে। শিবলী মোকতাদির শরতের কাছে তার অনেক ঋণ ভেবে লিখেছেন, ‘হায় শরৎ! তোমার কাছে অনেক ঋণ’। শরৎ নিয়ে ভাললাগা একটি প্রবন্ধ। উদয় শঙ্কর দুর্জয় ‘কবিতায় পাশ্চাত্য শরৎ এবং শরতে পাশ্চাত্য কবিরা’ শিরোনামে পাশ্চাত্য কবিরা শরৎ নিয়ে কে কি ধরনের ভাবনার পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন তার একটি বিবরণ তুলে ধরেছেন তার এ প্রবন্ধে। ‘সবিনয় আগমনে শরৎ আসে’ শিরোনামে তরুণ প্রাবন্ধিক হাসনাত মোবারক লিখেছেন। তার প্রবন্ধটিও শরৎ সংখ্যার সমৃদ্ধ একটি লেখা। শরতের পদাবলি শিরোনামে কবিতা লিখেছেন, মুহম্মদ নূরুল হুদা, কাজী রোজী, মৃণাল বসুচৌধুরী, ফরিদ আহমেদ দুলাল, মাহমুদ কামাল, আলমগীর রেজা চৌধুরী, সরকার মাহবুব, আবু ফরহাদ, তোফায়েল তফাজ্জল, পদ্মনাভ অধিকারী, তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ মুকুল, গোলাম কিবরিয়া পিনু, ওয়ালী কিরণ, রইস মনরম, তাহমিনা কোরাইশী, বাবুল আশরাফ, আমিনুল ইসলাম, রোকেয়া ইসলাম, কামরুল ইসলাম, বীরেন মুখার্জী, বদরুল হায়দার, আনোয়ার কামাল, ফরিদুজ্জামান, মিজানুর রহমান বেলাল, আমিরুল বাসার, ইফতেখার হালিম, হাফিজ রহমান, চন্দনকৃষ্ণ পাল, অরূপম মাইতি, ফজলুল হক তুহিন, জাকিয়া এস আরা, কাজী মোহিনী ইসলাম, হাসনাত আমজাদ, পিয়াস মজিদ, মুজিব ইরম, হাসিদা মুন, নাহিদা আশরাফী, ভোলা দেবনাথ, চন্দ্রশিলা ছন্দ্রা, আলী প্রয়াস, আশরাফুর রহমান খান, আশরাফ জুয়েল, সাঈদা নাঈম, সাফিয়া খন্দকার রেখা, আনোয়ার রশীদ সাগর, আমিনুল ইসলাম সেলিম, মোকসেদুল ইসলাম, সৈয়দ রনো, জিয়াবুল ইবন, প্রত্যয় হামিদ, অধরা জ্যোতি, জলিল আহমেদ, জেবুননেসা হেলেন, ইসলাম রফিক, মিলন বণিক, লতিফ জোয়ার্দার, বিদ্যুৎ বিহারি, মনসুর আজিজ, আল মাকসুদ, আমিনা শেলী, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, ইমরান মাহফুজ, মনিরুজ্জামান পলাশ, মাসুম মুনাওয়ার, জগৎ জ্যোতি চাকমা, জাবেদ এ ইমন, সোহেল মল্লিক, সুমন রায়হান, আমিনুল ইসলাম মামুন, জুলফিকার রবিন, নকিব মুকশি, জাকির সোহান, আমির আসহাব, রহিমা আক্তার মৌ, কহন কুদ্দুস, ইলিয়াস বাবর, কিংশুক ভট্টাচার্য, অজুফা আখতার, মোস্তফা হায়দার, ফরজানা তনিমা, সমীর চন্দ্র দাশ, মুহাম্মাদ রেজাউল করিম, শাহিন আলম, অভিলাষ মাহমুদ, জাহাঙ্গীর বিশ্বাস, মাহমুদ রিজভী ও আল জাবিরী। অনূদিত কবিতায় আমেরিকার কবি আর জানিয়াসের কবিতা ভাষান্তর করেছেন, আবুল কাইয়ুম আর সিলভিয়া প্ল্যাথের কবিতা ভাষান্তর করেছেন, কাজী রহিম শাহরিয়ার। গল্প লিখেছেন, সালাম সালেহ উদদীন, দীপু মাহমুদ, মাসকাওয়াথ আহসান, জয়দীপ দে ও সমীর আহমেদ। অনূদিত বিদেশি গল্প বিভাগে আফ্রিকান গল্পকার চিমামান্দা নগোজি আদিচি এর গল্প ভাষান্তর করেছেন, মনোজিৎ কুমার দাস। অণুগল্প লিখেছেন, সাধন দাস, অদিতি ফাল্গুনী, চন্দন চৌধুরী ও রুনা রোকসানা। মুখোমুখি বিভাগে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এর সত্তর তম জন্মদিন উপলক্ষে একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার রয়েছে। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন অলাত এহ্সান। যা পত্রিকাটির শ্রী বৃদ্ধি করেছে। এ ছাড়াও গ্রন্থালোচনা বিভাগে কথাসাহিত্যিক তপন দেবনাথের ‘দূর নক্ষত্রের গল্প’ গ্রন্থের আলোচনা করেছেন ড. কাজী নাসির উদ্দীন। ১২৮ পৃষ্ঠার পত্রিকাটি উন্নত মানের অফসেট পেপারে ঝকঝকে ছাপা আর পরতে পরতে শরতের আবহ সৃষ্টি করে যে নান্দনিকতার মূর্ছনা আনা হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এ ছাড়া প্রবীণ প্রথিতযশা লেখকদের সঙ্গে তরুণ লেখকদের একটা সেতুবন্ধন করা হয়েছে এ সংখ্যাটিতে। ‘এবং মানুষ’ বিষয়ভিত্তিক নিয়মিত ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বেরুচ্ছে। এ সংখ্যাটি ২য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা। প্রচ্ছদ করেছেন কাব্য কারিম আর নামলিপি করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র পঞ্চাশ টাকা। পত্রিকাটি পাঠকপ্রিয়তা এবং দীর্ঘ পথপরিক্রম করুক এ প্রত্যাশা করছি।
×